প্রথম পর্ব : (দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন)
"বাড়ির পাশে আরশিনগর
"বাড়ির পাশে আরশিনগর
সেথায় এক পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে"
লালন ফকিরের এই জনপ্রিয় গানের সূত্র ধরেই আজকের লেখা শুরু করছি।সত্যি ভ্রমণের অদম্য নেশায় আমরা কত দূরদূরান্তে ছুটে যাই,অথচ বাড়ির কাছেই কত অজস্র মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে,তা অনেক সময়ই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়।আজ এরকমই এক বেড়ানোর হদিস দেবো।কোলকাতা থেকে মাত্র 330 কিমি দূরে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার মালদা।এখানেই রয়েছে বাংলার দুই প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদ গৌড় ও পাণ্ডুয়া।সপ্তাহান্তের দুদিনের ছুটিতে খুব সহজেই আর কম খরচে দেখে নেওয়া যায়।এর জন্য বিশেষ প্ল্যানিং এরও দরকার নেই।শুক্রবার রাতে রওনা দিয়ে শনিবার সকালেই পৌছে যান মালদা শহরে।হোটেলে চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে একটা গাড়ি নিয়ে রওনা দিন গৌড়ের উদ্দেশ্যে।কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন এসব তথ্য অবশ্যই যথাসময়ে জানাবো।আসুন তার আগে গৌড়ের ইতিহাসটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক।তাতে ঘোরাটা অনেক বেশি আকর্ষণীয় হবে নিঃসেন্দহে।
পুরাণে এই গৌড় ও পাণ্ডুয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়।দেবীপুরাণ ও পদ্মপুরাণে পুণ্ড্রবর্দ্ধন নামের উল্লেখ আছে।মনে করা হয় এটাই বর্তমান পাণ্ডুয়া।পাণিনির লেখাতেও গৌড়পুরা বলে জায়গার কথা আছে।পণ্ডিতদের মতে সম্ভবতঃ সংস্কৃত গুড় কথাটি থেকে এই গৌড় নামের উৎপত্তি। এক সময় এই অঞ্চল মৌর্য ও পরে গুপ্ত বংশের অধীনে ছিল।জনশ্রুতি প্রথম গুপ্ত সম্রাট শ্রীগুপ্তের জন্মস্থান এই মালদারই কোথাও ছিল।পরে গুপ্তরাজাদের দুর্বলতার সুযোগে শশাঙ্ক নামে এক বাঙালি সামন্তরাজা (606-637 AD) এই গৌড়ে তার স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।শশাঙ্কের রাজত্বকালের শেষদিকে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এই পুণ্ড্রবর্দ্ধন রাজ্যে এসেছিলেন।এর পরের প্রায় একশো বছরের ইতিহাস অন্ধকারাচ্ছন্ন,বিশেষ কিছু জানা যায় না।743 খ্রীস্টাব্দে প্রথম গোপালের হাতে পাল বংশের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এই অঞ্চল পালরাজাদের অধীনে চলে যায়।এরা বৌদ্ধ ছিলেন।পাল রাজাদের পতনের পর এলেন সেন রাজারা।বল্লাল সেন ও লক্ষণ সেনের (1169-1206 AD)আমলে এর নাম ছিল লক্ষণাবতী।1198 খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের পরে পরেই বঙ্গদেশে শুরু হয় মুসলিম রাজত্ব।সেসময় প্রায় চারশো বছর ধরে এই গৌড়ই ছিল বাংলার রাজধানী।পরে বাংলার সুলতানরা দিল্লির শাসকদের থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে পাণ্ডুয়াকে তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু করে তোলেন।1539 সালে শের শাহ সুরী গৌড়ের স্থানীয় শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করেন।শেষমেশ 1575 সালে আকবরের জেনারেল মুনিম খান এর দখল নেন।তারপরই সম্ভবতঃ প্লেগ মহামারীর জন্য আর গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের কারণে গৌড়ের পতনের শুরু এবং একসময়ের ব্যস্ত এই জনপদ পরিত্যক্ত হয়ে জঙ্গল ও আগাছায় ভরা এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
অনেক ইতিহাস কপচানো হল,চলুন আবার বর্তমানে ফিরে আসি।গাড়ি মালদা শহর ছাড়িয়ে NH 34 ধরে দক্ষিণ দিকে বেশ কিছুটা চলার পর সুস্থানি মোড় থেকে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে সুন্দর রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে।রাস্তার পাশে মাঝেমাঝেই স্টোন চিপস ও অন্যান্য মালপত্র বোঝাই লরির সারি।এগুলি সব যাবে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে।এই রাস্তা সোজা চলে গেছে মহদিপুর বর্ডার পর্যন্ত যার ওপারেই বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা।দুপাশে সবুজ ধানক্ষেত,বিস্তীর্ণ জলাশয়,সারিসারি আমবাগান দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবেন পিয়াসবাড়ি মোড়ে।বেশকিছু দোকানপাট নিয়ে একটা ছোট্ট গঞ্জের মতো।বাঁদিকে পড়বে এক বিশাল দিঘী,পিয়াসবাড়ি দিঘী।এর পিছনে এক কাহিনী আছে।শোনা যায় সুলতানী আমলে এই দিঘীর জলে বিষ মিশিয়ে রাখা হত,আর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত তৃষ্ণার্ত আসামিদের বাধ্য করা হত এই বিষাক্ত জল পান করতে।আবুল ফজলের লেখা থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবর এই প্রথা আদেশ জারি করে বন্ধ করেছিলেন। এখানে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে একটু গলা ভিজিয়ে ডান দিকে বাঁক নিয়ে শুরু হবে আপনার গৌড় ভ্রমণ।পরপর যেভাবে দর্শনীয় স্থানগুলি আসবে সেভাবেই বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
রামকেলি-বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক পবিত্র তীর্থস্থান এই রামকেলি।এখানে রয়েছে রূপ সনাতনের সেই সনাতন গোস্বামীর প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন মন্দির।মন্দিরে রয়েছে মদনমোহন আর শ্রীরাধার মূর্তি যার এখনও নিত্যপূজা হয়।পাশেই একটি ছোট মন্দিরের মধ্যে আছে শ্রীচৈতন্যদেবের পদচিহ্ন।1515 সালের জৈষ্ঠমাসের সংক্রান্তির দিন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য নীলাচল থেকে ফেরার পথে এই রামকেলিতে কেলিকদম্ব ও তমাল গাছের নীচে ভক্তবৃন্দ পরিবৃত হয়ে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন।সেই ঘটনাকে স্মরণ করে প্রতিবছর জৈষ্ঠসংক্রান্তির দিন থেকে শুরু করে সাতদিন ধরে এখানে এক মেলা বসে।এই মেলা সমস্ত বৈষ্ণবদের কাছে এক মহামিলনক্ষেত্র।সাতদিন ধরে বিভিন্ন আখড়ায় নাম সংকীর্তন চলে।কিছুদিন আগেও একটা প্রথা চালু ছিল,কণ্ঠিবদল।কাপড়ের আড়ালে মুখ ঢাকা বৈষ্ণবীর শুধুমাত্র কড়ে আঙুল দেখে তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে নির্বাচন করা হত।এখন অবশ্য সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত রামকেলির মদনমোহন মন্দির দর্শনের পর গৌড়ের বাকি দর্শনীয় স্থানগুলি দেখে নেব।
ফিরোজ মিনার- রামকেলির মন্দির দেখা শেষ করে পাশের সুন্দর পিচঢালা পথ দিয়ে কিছুটা গেলেই ডানদিকে এই স্থাপত্যটির দেখা মিলবে।দিল্লির কুতুব মিনারের আদলে তৈরি এই মিনারটির উচ্চতা 25.6 মিটার।ভিতরের 73 টি ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে একসময় এর উপরে যাওয়া যেত,কিন্তু এখন সেটা বন্ধ।সৈফুদ্দিন ফিরোজ নামে একজন বাদশা এটি তৈরী করেন,নির্মাণ কাল 1586-1589 খ্রিস্টাব্দ।উল্টোদিকেই একটি সুন্দর টলটলে জলের দিঘী।
কদম রসুল মসজিদ- চতুষ্কোণ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি তৈরী করেন সুলতান নসরত শাহ,1531 খ্রিস্টাব্দে।মসজিদের ভিতরে একটি কালো পাথরের উপর হজরত মহম্মদের কদম অর্থাত্ পদচিহ্ন রয়েছে,তাই নাম কদম রসুল মসজিদ।পাশেই আছে একটি বিশ্রামাগারের ধ্বংসাবশেষ,যেটা আগত দর্শকদের বিশ্রামের কাজে ব্যবহার হত।
ফতে খাঁয়ের সমাধি-কদম রসুল মসজিদ চত্বরের মধ্যেই রয়েছে এই সমাধি।এই ফতে খাঁ ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি দিলওয়ার খানের পুত্র।শোনা যায় সুলতান সুজাকে বিদ্রোহ করতে পরামর্শ দেওয়ার অপরাধে পীর শাহ নিয়ামতুল্লাকে হত্যা করার জন্য সম্রাট এই ফতে খাঁকে পাঠিয়েছিলেন।এখানে এসেই তিনি রক্তবমি করে মারা যান।সমাধির গঠনশৈলীতে প্রাচীন বাংলার মন্দিরের আদল স্পষ্ট।
লুকোচুরি দরওয়াজা- এটির নির্মাতা বাদশা শাহ সুজা,নির্মাণকাল 1655 খ্রিস্টাব্দ।দোতলা এই স্থাপত্যটি ছিল গৌড়ীয় প্রাসাদ চত্বরের পূর্বদিকের প্রবেশদ্বার।এর উপরের তলটি নহবতখানা বা নক্করখানা(জয়ঢাক বাজানোর জায়গা) হিসাবে ব্যবহৃত হত।দুদিকে প্রহরীদের থাকার জন্য অনেকগুলি ছোট ছোট ঘর আছে।অনেকের মতে বাদশা এখানে তার বিবিদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন বলে এরকম নাম।
চিকা বা চামকান মসজিদ- এটি সম্ভবতঃ আদতে ছিল একটি সমাধিস্থল।নির্মাতা সুলতান সামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ (1475-1481)। আবার কেউ কেউ বলেন সুলতান হুসেন শাহ (1493-1519) এটিকে কারাগার হিসাবে ব্যবহার করতেন।একসময় এর ভিতরে প্রচুর চামচিকা বাস করত,তার থেকেই সম্ভবতঃ এর নাম হয়েছে চিকা মসজিদ।আবার মুসলিম চর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগ থাকার কারণে সম্ভবত এর নাম হয়েছে চামকান মসজিদ। দেয়ালে অনেক কারুকাজ করা পাথর,মীনা করা ইঁট,হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।
গুমটি দরওয়াজা -চিকা মসজিদের পাশেই মীনা করা ইঁট দিয়ে তৈরী এই গেট।এক বিশাল গড়ের মাঝখানে এটিকে একটি গোপন পথ হিসাবে ব্যবহার করা হত বলে এর নাম গুমটি গেট।সম্ভবতঃ বাদশা হুসেন শাহের আমলে তৈরী,1512 খ্রিস্টাব্দে।এটি ছিল গৌড় দুর্গের পূর্ব দিকের প্রবেশপথ।
বাইশগজী দেয়াল-একসময় গৌড়ের মূল রাজপ্রাসাদ কে বেষ্টন করে ছিল বাইশ গজ উঁচু এই প্রাচীর,তাই এর নাম বাইশ গজী দেয়াল।নীচের অংশে সাড়ে চার মিটার আর উপরের দিকে প্রায় তিন মিটার চওড়া এই প্রাচীরের উপর দিয়ে একটা ঘোড়া অনায়াসেই দৌড়ে যেতে পারত বলে এর আরেক নাম ছিল"ঘোড় দৌড়ের প্রাচীর"।আজ এই দেয়ালের সামান্য কিছু অংশই অবশিষ্ট আছে।বাদশা বরবক শাহ 1460 খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন।
বল্লালবাটি-বাইশগজী দেয়াল থেকে আমবাগানের মধ্যে দিয়ে কিছুটা গেলেই দেখা যাবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার খোঁড়াখুঁড়ির ফলে বেরিয়ে আসা একটি স্থাপত্যের ভিত।ইঁটের তৈরী পরপর অনেকগুলি গোলাকার স্তম্ভের অংশ,যেগুলি সম্ভবতঃ চুল্লি হিসাবে ব্যবহার করা হত।
জাহাজঘাটা-একসময় গঙ্গানদী এই জায়গার পাশ দিয়েই বয়ে যেত।তখন বড় বড় নৌকা,বজরা ইত্যাদি বেঁধে রাখার জন্য মোটা মোটা লোহার শিকল আটকানো ছিল।কিন্তু সেগুলি আজ আর দেখতে পাওয়া যায় না,চোরেরা সব কেটে নিয়ে গেছে।গঙ্গাও এখন তার গতিপথ পরিবর্তন করে প্রায় 20 কিমি দূর দিয়ে বইছে।
সেলামি দরওয়াজা- এর আরেক নাম দাখিল দরওয়াজা।এটি ছিল গৌড় দূর্গ ও রাজপ্রাসাদের দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বার। কোনও মহামান্য অতিথি অভ্যাগত এলে এই দরজার উপর থেকে কামান দেগে অভ্যর্থনা করা হত,তাই নাম হয়েছে সেলামি দরওয়াজা।এর নির্মাণ সম্ভবতঃ 1425 খ্রিস্টাব্দে,সুলতান বরবক শাহের হাতে।তবে নির্মাতা ও নির্মাণকাল নিয়ে মতভেদ আছে।
বারোদুয়ারী বা বড়সোনা মসজিদ- গৌড়ের মুসলিম শাসকদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি।সুলতান আলাউদ্দিন শাহর পুত্র নাসিরুদ্দিন নসরত শাহর হাতে 1526 সালে তৈরী।এর বারটি দুয়ার বা দরজা থাকার জন্য এরকম নাম,যদিও এখন 11 টি দেখা যায়।মাঝের গম্বুজের উপর সোনালী চিকনের কাজের জন্য আর এক নাম বড় সোনা মসজিদ।উত্তর দিকে মহিলাদের বসার জন্য একটা মঞ্চের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।উত্তর,পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে তিনটি তোরণ আছে।
চামকাটি মসজিদ-পিয়াসবাড়ি থেকে যে সোজা রাস্তা মহদীপুর সীমান্তর দিকে গেছে তার ডানদিকেই পড়বে এই মসজিদটি।এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদ সুলতান ইউসুফ শাহর দ্বারা 1475 সালে তৈরী।এর মিনে করা ইঁটের কাজ দর্শনীয়।একসময় মুসলিম চর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগ থাকার জন্য সম্ভবতঃ এরকম নামকরণ।
তাঁতিপাড়া মসজিদ- সুলতান ইউসুফ শাহর রাজত্বকালে উমর কাজি নামে একজন 1480 সালে এই মসজিদটি তৈরী করেন।এর মধ্যে দুটি কবর আছে,একটি উমর কাজি আর অপরটি তার মেয়ের।এই মসজিদের ইঁটের টেরাকোটার কাজ দর্শনীয়।
লোটন মসজিদ -তাঁতিপাড়া মসজিদ দেখে মহদিপুর সীমান্তের দিকে এগিয়ে গেলে পথের ডানদিকে পড়বে।এই মসজিদের নানারঙের মিনে করা ইঁটের কাজ উল্লেখযোগ্য।অনেকের মতে মীরাবাঈ নামে এক হিন্দু নর্তকী মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে এই মসজিদটি তৈরী করেন।
গুণমন্ত মসজিদ- মূল রাস্তা ছেড়ে লোটন মসজিদের উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে এক কিমি মত গেলেই এই মসজিদটি চোখে পড়বে।একটু অন্যদিকে হওয়ার জন্য খুব কম দর্শকই এটি দেখতে আসেন।সুলতান জালালুদ্দিন ফতে শাহর হাতে 1484 সালে তৈরী।এর তিনটি তোরণদ্বারের মধ্যে মাত্র পূবদিকেরটি এখন অবশিষ্ট আছে।ছাদে ছোটছোট 24 টি গম্বুজ ও মাঝখানে নৌকার ছইয়ের মত ভল্ট আছে।দক্ষিণ পৃর্বদিকে একটি উঁচু পীঠ আছে যেখান থেকে মুয়াজ্জিমরা নামাজ পড়তেন।
কোতোয়ালি দরওয়াজা -এটি গৌড় নগরীর দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বার ।এর মধ্যে দিয়ে পিচঢালা পথ চলে গেছে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে।বিএসএফ জওয়ানদের কড়া পাহারা।আগে জওয়ানদের অনুমতি নিয়ে নো ম্যানস ল্যান্ডের সীমানা পর্যন্ত চলে যাওয়া যেত,এমনকি ওপারের দর্শকদের সাথে কিছু বাক্য বিনিময়,করমর্দন এসবেও তেমন বিধিনিষেধ ছিল না।কিন্তু এখন অনেক কড়াকড়ি,তাই দূর থেকে হাত নেড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। একসময় গৌড়ের স্থাপত্যগুলি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় ধ্বংসের মুখে চলে গিয়েছিল,তার উপর ছিল স্থানীয় মানুষদের অবিবেচকের মত কাজ।সৌধগুলি থেকে ইঁট,পাথর ইত্যাদি খুলে নিয়ে তারা নিজেদের বাড়ি ঘর তৈরীর কাজে লাগিয়েছে।একদা একটু সন্ধ্যে হলেই চুরি ছিনতাই লেগে থাকত। তবে এখন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধিগ্রহণের পর পরিস্থিতি পাল্টেছে।সৌধগুলির চারিদিকে বেড়া,সুন্দর বাগান হয়েছে,পাহারা বসেছে।তাই গৌড় ভ্রমণ এখন অনেক নিরাপদ।গেলে দেখা যাবে কিছুকিছু বেশী ক্ষতিগ্রস্ত সৌধের জোরকদমে সংস্কার চলছে।আমাদের গৌড় ভ্রমণ এখানেই শেষ।যে পথ দিয়ে এসেছি সেপথেই ফিরে যাব মালদা শহরের দিকে।হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে বাংলার আর এক প্রাচীন রাজধানী পাণ্ডুয়ার উদ্দেশে।
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রামকেলি-বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক পবিত্র তীর্থস্থান এই রামকেলি।এখানে রয়েছে রূপ সনাতনের সেই সনাতন গোস্বামীর প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন মন্দির।মন্দিরে রয়েছে মদনমোহন আর শ্রীরাধার মূর্তি যার এখনও নিত্যপূজা হয়।পাশেই একটি ছোট মন্দিরের মধ্যে আছে শ্রীচৈতন্যদেবের পদচিহ্ন।1515 সালের জৈষ্ঠমাসের সংক্রান্তির দিন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য নীলাচল থেকে ফেরার পথে এই রামকেলিতে কেলিকদম্ব ও তমাল গাছের নীচে ভক্তবৃন্দ পরিবৃত হয়ে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন।সেই ঘটনাকে স্মরণ করে প্রতিবছর জৈষ্ঠসংক্রান্তির দিন থেকে শুরু করে সাতদিন ধরে এখানে এক মেলা বসে।এই মেলা সমস্ত বৈষ্ণবদের কাছে এক মহামিলনক্ষেত্র।সাতদিন ধরে বিভিন্ন আখড়ায় নাম সংকীর্তন চলে।কিছুদিন আগেও একটা প্রথা চালু ছিল,কণ্ঠিবদল।কাপড়ের আড়ালে মুখ ঢাকা বৈষ্ণবীর শুধুমাত্র কড়ে আঙুল দেখে তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে নির্বাচন করা হত।এখন অবশ্য সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।
মন্দিরের ভিতরে মদনমোহন ও শ্রীরাধার মূর্তি |
মদনমোহন মন্দির,রামকেলি |
এই মন্দিরটির ভিতরেই রক্ষিত আছে শ্রীচৈতন্যদেবের পদচিহ্ন |
ফিরোজ মিনার- রামকেলির মন্দির দেখা শেষ করে পাশের সুন্দর পিচঢালা পথ দিয়ে কিছুটা গেলেই ডানদিকে এই স্থাপত্যটির দেখা মিলবে।দিল্লির কুতুব মিনারের আদলে তৈরি এই মিনারটির উচ্চতা 25.6 মিটার।ভিতরের 73 টি ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে একসময় এর উপরে যাওয়া যেত,কিন্তু এখন সেটা বন্ধ।সৈফুদ্দিন ফিরোজ নামে একজন বাদশা এটি তৈরী করেন,নির্মাণ কাল 1586-1589 খ্রিস্টাব্দ।উল্টোদিকেই একটি সুন্দর টলটলে জলের দিঘী।
কদম রসুল মসজিদ- চতুষ্কোণ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি তৈরী করেন সুলতান নসরত শাহ,1531 খ্রিস্টাব্দে।মসজিদের ভিতরে একটি কালো পাথরের উপর হজরত মহম্মদের কদম অর্থাত্ পদচিহ্ন রয়েছে,তাই নাম কদম রসুল মসজিদ।পাশেই আছে একটি বিশ্রামাগারের ধ্বংসাবশেষ,যেটা আগত দর্শকদের বিশ্রামের কাজে ব্যবহার হত।
ফতে খাঁয়ের সমাধি-কদম রসুল মসজিদ চত্বরের মধ্যেই রয়েছে এই সমাধি।এই ফতে খাঁ ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি দিলওয়ার খানের পুত্র।শোনা যায় সুলতান সুজাকে বিদ্রোহ করতে পরামর্শ দেওয়ার অপরাধে পীর শাহ নিয়ামতুল্লাকে হত্যা করার জন্য সম্রাট এই ফতে খাঁকে পাঠিয়েছিলেন।এখানে এসেই তিনি রক্তবমি করে মারা যান।সমাধির গঠনশৈলীতে প্রাচীন বাংলার মন্দিরের আদল স্পষ্ট।
লুকোচুরি দরওয়াজা- এটির নির্মাতা বাদশা শাহ সুজা,নির্মাণকাল 1655 খ্রিস্টাব্দ।দোতলা এই স্থাপত্যটি ছিল গৌড়ীয় প্রাসাদ চত্বরের পূর্বদিকের প্রবেশদ্বার।এর উপরের তলটি নহবতখানা বা নক্করখানা(জয়ঢাক বাজানোর জায়গা) হিসাবে ব্যবহৃত হত।দুদিকে প্রহরীদের থাকার জন্য অনেকগুলি ছোট ছোট ঘর আছে।অনেকের মতে বাদশা এখানে তার বিবিদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন বলে এরকম নাম।
চিকা বা চামকান মসজিদ- এটি সম্ভবতঃ আদতে ছিল একটি সমাধিস্থল।নির্মাতা সুলতান সামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ (1475-1481)। আবার কেউ কেউ বলেন সুলতান হুসেন শাহ (1493-1519) এটিকে কারাগার হিসাবে ব্যবহার করতেন।একসময় এর ভিতরে প্রচুর চামচিকা বাস করত,তার থেকেই সম্ভবতঃ এর নাম হয়েছে চিকা মসজিদ।আবার মুসলিম চর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগ থাকার কারণে সম্ভবত এর নাম হয়েছে চামকান মসজিদ। দেয়ালে অনেক কারুকাজ করা পাথর,মীনা করা ইঁট,হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।
গুমটি দরওয়াজা -চিকা মসজিদের পাশেই মীনা করা ইঁট দিয়ে তৈরী এই গেট।এক বিশাল গড়ের মাঝখানে এটিকে একটি গোপন পথ হিসাবে ব্যবহার করা হত বলে এর নাম গুমটি গেট।সম্ভবতঃ বাদশা হুসেন শাহের আমলে তৈরী,1512 খ্রিস্টাব্দে।এটি ছিল গৌড় দুর্গের পূর্ব দিকের প্রবেশপথ।
বাইশগজী দেয়াল-একসময় গৌড়ের মূল রাজপ্রাসাদ কে বেষ্টন করে ছিল বাইশ গজ উঁচু এই প্রাচীর,তাই এর নাম বাইশ গজী দেয়াল।নীচের অংশে সাড়ে চার মিটার আর উপরের দিকে প্রায় তিন মিটার চওড়া এই প্রাচীরের উপর দিয়ে একটা ঘোড়া অনায়াসেই দৌড়ে যেতে পারত বলে এর আরেক নাম ছিল"ঘোড় দৌড়ের প্রাচীর"।আজ এই দেয়ালের সামান্য কিছু অংশই অবশিষ্ট আছে।বাদশা বরবক শাহ 1460 খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন।
বল্লালবাটি-বাইশগজী দেয়াল থেকে আমবাগানের মধ্যে দিয়ে কিছুটা গেলেই দেখা যাবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার খোঁড়াখুঁড়ির ফলে বেরিয়ে আসা একটি স্থাপত্যের ভিত।ইঁটের তৈরী পরপর অনেকগুলি গোলাকার স্তম্ভের অংশ,যেগুলি সম্ভবতঃ চুল্লি হিসাবে ব্যবহার করা হত।
জাহাজঘাটা-একসময় গঙ্গানদী এই জায়গার পাশ দিয়েই বয়ে যেত।তখন বড় বড় নৌকা,বজরা ইত্যাদি বেঁধে রাখার জন্য মোটা মোটা লোহার শিকল আটকানো ছিল।কিন্তু সেগুলি আজ আর দেখতে পাওয়া যায় না,চোরেরা সব কেটে নিয়ে গেছে।গঙ্গাও এখন তার গতিপথ পরিবর্তন করে প্রায় 20 কিমি দূর দিয়ে বইছে।
সেলামি দরওয়াজা- এর আরেক নাম দাখিল দরওয়াজা।এটি ছিল গৌড় দূর্গ ও রাজপ্রাসাদের দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বার। কোনও মহামান্য অতিথি অভ্যাগত এলে এই দরজার উপর থেকে কামান দেগে অভ্যর্থনা করা হত,তাই নাম হয়েছে সেলামি দরওয়াজা।এর নির্মাণ সম্ভবতঃ 1425 খ্রিস্টাব্দে,সুলতান বরবক শাহের হাতে।তবে নির্মাতা ও নির্মাণকাল নিয়ে মতভেদ আছে।
বারোদুয়ারী বা বড়সোনা মসজিদ- গৌড়ের মুসলিম শাসকদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি।সুলতান আলাউদ্দিন শাহর পুত্র নাসিরুদ্দিন নসরত শাহর হাতে 1526 সালে তৈরী।এর বারটি দুয়ার বা দরজা থাকার জন্য এরকম নাম,যদিও এখন 11 টি দেখা যায়।মাঝের গম্বুজের উপর সোনালী চিকনের কাজের জন্য আর এক নাম বড় সোনা মসজিদ।উত্তর দিকে মহিলাদের বসার জন্য একটা মঞ্চের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।উত্তর,পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে তিনটি তোরণ আছে।
চামকাটি মসজিদ-পিয়াসবাড়ি থেকে যে সোজা রাস্তা মহদীপুর সীমান্তর দিকে গেছে তার ডানদিকেই পড়বে এই মসজিদটি।এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদ সুলতান ইউসুফ শাহর দ্বারা 1475 সালে তৈরী।এর মিনে করা ইঁটের কাজ দর্শনীয়।একসময় মুসলিম চর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগ থাকার জন্য সম্ভবতঃ এরকম নামকরণ।
তাঁতিপাড়া মসজিদ- সুলতান ইউসুফ শাহর রাজত্বকালে উমর কাজি নামে একজন 1480 সালে এই মসজিদটি তৈরী করেন।এর মধ্যে দুটি কবর আছে,একটি উমর কাজি আর অপরটি তার মেয়ের।এই মসজিদের ইঁটের টেরাকোটার কাজ দর্শনীয়।
লোটন মসজিদ -তাঁতিপাড়া মসজিদ দেখে মহদিপুর সীমান্তের দিকে এগিয়ে গেলে পথের ডানদিকে পড়বে।এই মসজিদের নানারঙের মিনে করা ইঁটের কাজ উল্লেখযোগ্য।অনেকের মতে মীরাবাঈ নামে এক হিন্দু নর্তকী মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে এই মসজিদটি তৈরী করেন।
গুণমন্ত মসজিদ- মূল রাস্তা ছেড়ে লোটন মসজিদের উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে এক কিমি মত গেলেই এই মসজিদটি চোখে পড়বে।একটু অন্যদিকে হওয়ার জন্য খুব কম দর্শকই এটি দেখতে আসেন।সুলতান জালালুদ্দিন ফতে শাহর হাতে 1484 সালে তৈরী।এর তিনটি তোরণদ্বারের মধ্যে মাত্র পূবদিকেরটি এখন অবশিষ্ট আছে।ছাদে ছোটছোট 24 টি গম্বুজ ও মাঝখানে নৌকার ছইয়ের মত ভল্ট আছে।দক্ষিণ পৃর্বদিকে একটি উঁচু পীঠ আছে যেখান থেকে মুয়াজ্জিমরা নামাজ পড়তেন।
কোতোয়ালি দরওয়াজা -এটি গৌড় নগরীর দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বার ।এর মধ্যে দিয়ে পিচঢালা পথ চলে গেছে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে।বিএসএফ জওয়ানদের কড়া পাহারা।আগে জওয়ানদের অনুমতি নিয়ে নো ম্যানস ল্যান্ডের সীমানা পর্যন্ত চলে যাওয়া যেত,এমনকি ওপারের দর্শকদের সাথে কিছু বাক্য বিনিময়,করমর্দন এসবেও তেমন বিধিনিষেধ ছিল না।কিন্তু এখন অনেক কড়াকড়ি,তাই দূর থেকে হাত নেড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। একসময় গৌড়ের স্থাপত্যগুলি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় ধ্বংসের মুখে চলে গিয়েছিল,তার উপর ছিল স্থানীয় মানুষদের অবিবেচকের মত কাজ।সৌধগুলি থেকে ইঁট,পাথর ইত্যাদি খুলে নিয়ে তারা নিজেদের বাড়ি ঘর তৈরীর কাজে লাগিয়েছে।একদা একটু সন্ধ্যে হলেই চুরি ছিনতাই লেগে থাকত। তবে এখন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধিগ্রহণের পর পরিস্থিতি পাল্টেছে।সৌধগুলির চারিদিকে বেড়া,সুন্দর বাগান হয়েছে,পাহারা বসেছে।তাই গৌড় ভ্রমণ এখন অনেক নিরাপদ।গেলে দেখা যাবে কিছুকিছু বেশী ক্ষতিগ্রস্ত সৌধের জোরকদমে সংস্কার চলছে।আমাদের গৌড় ভ্রমণ এখানেই শেষ।যে পথ দিয়ে এসেছি সেপথেই ফিরে যাব মালদা শহরের দিকে।হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে বাংলার আর এক প্রাচীন রাজধানী পাণ্ডুয়ার উদ্দেশে।
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
No comments