ভ্রমণের প্রতি মানুষের টান চিরন্তন।যদিও সকল মানুষ ভ্রমণ পিপাসু হয় না, কিন্তু পায়ের তলায় সরষে যুক্ত মানুষের সংখ্যা ও নেহাত কম নয়। সুযোগ সুবিধা মত ভ্রমণ পিপাসু মন " উঠিয়ে ঝোল, চলল ভোলা"--বলে রওনা দেয়।
ভ্রমণ বিষয়টিতে এক সময় বাঙালির একচেটিয়া অধিকার ছিল।এখন শুধু বাঙালি নয়, ভ্রমণে উৎসাহী জনতার মধ্যে অন্যান্য প্রদেশের মানুষ ও সামিল হয়েছেন।তবে যাই হোক না কেন বাঙালির নাম এখনও ভ্রমণ পিপাসুদের তালিকার শীর্ষে-ই রয়েছে।
অজ্ঞানত আমার প্রথম ভ্রমন দীঘা।সে ভ্রমণের গল্প আমার মায়ের মুখেই শোনা।সে ভ্রমণের গল্প মায়ের মুখে ই শোনা।মনে নেই সেই ছোট্ট বেলার প্রথম সমুদ্র দর্শন। পরবর্তী দীর্ঘ ভ্রমণ ছিল Travel Agency র মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভ্রমণ, ইতিহাসের প্রাণকেন্দ্র রাজস্থানে।ইতিহাস চিরকাল ই আমার খুব প্রিয় বিষয়, তাই এই ভ্রমণ ছিল ইতিহাস কে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা।
আমার মায়ের ছিল ভ্রমণের শখ্, কিন্তু অনুকূল পরিবেশ, পরিস্থিতির অভাবে তা নেশায় পরিণত করার সৌভাগ্য ঘটেনি।কিছু কিছু ভ্রমণের গল্প শুনেছি মায়ের কাছে।সেই সব গল্প শুনেই ভ্রমণে র প্রতি আগ্রহের সঞ্চার হয় আমার মনে। আগ্রহ হলেও অজ্ঞাত কে জানার, চেনার এক অহেতুক ভীতি ও তখন কাজ করত। কিন্তু সেই ভীতি একটু একটু করে কেটে গেল আমার বিয়ের পর।কারণ বিয়ের পর একটা নতুন ভ্রমণ পিপাসু বন্ধু পেলাম যে !!!!
কিছু ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলেও অনেক রয়েছে বাকি।আমাদের ভারতবর্ষের মধ্যে ভ্রমণের স্নানের অভাব নেই।এমনকি সত্যি বলতে কি এক জীবনে দেখে শেষ করা যায় না, প্রকৃতির এই অফুরন্ত ভাণ্ডার। কী নেই এখানে ? মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো পর্বতমালা, ফেনিল, সুনীল সমুদ্র, হ্রদ, নিবিড় অরণ্যভূমি , উষর মরুভূমি , নদী, হিমবাহ, জলপ্রপাত, ঝরণা, প্রাকৃতিক বন্দর, ঐতিহাসিক কাহিনী সমৃদ্ধ দূর্গ, রাজপ্রাসাদ , গুহামন্দির, অনবদ্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সমৃদ্ধ মন্দির, গীর্জা, মসজিদ।
২০১৭ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা গিয়েছিলাম উত্তর-উত্তরপূর্ব ভারতের কয়েকটি অঞ্চল ভ্রমণে।আমাদের গন্তব্য ছিল আসামের শহর গৌহাটি ও অরণ্য ভূমি কাজিরাঙা এবং মেঘালয়ের প্রসিদ্ধ কয়েকটি অঞ্চল ও মেঘালয়ের রাজধানী, কবিগুরুর "শেষের কবিতা খ্যাত শিলং।
গৌহাটি শহরটি বেশ সুন্দর।সব থেকে সুন্দর লাগলো ওখানকার বাসিন্দাদের।খুব সহজ সরল, শান্তিপ্রিয় বলেই বোধ হল।আসামের বাসিন্দা সংক্রান্ত অহেতুক ভীতি কিছুটা হলেও দূর হল এদের সহজ সরল ব্যবহারে।শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রক্ষ্মপুত্র নদ, শহরের সৌন্দর্যকে যেন অনেকঅনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে।শহরের এক পাশে আছে ছোট্ট অরণ্য পবিতোরা।সেখানে ঘটে বহু পরিযায়ী পাখির সমাবেশ। ব্রক্ষ্মপুত্র নদের মধ্যের একটি দ্বীপে আছে উমানন্দ মহাদেবের মন্দির।নৌকা করে সেখানে যেতে হয়।খরস্রোতা ব্রক্ষ্মপুত্র পেরিয়ে সেই মন্দির চত্বরে যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল হয়ে এসেছে।শান্ত পরিবেশ মনকে মুগ্ধ করে। ভক্ত সমাগম থাকলেও সবাই খুবই শান্তিপ্রিয়।হয়তো পরিবেশের মাহাত্ম্য ও আছে। তখন শান্ত পরিবেশে ভক্ত গণ ও যেন নিরবে নিভৃতে ভগবানের কাছে আর্তি জানায়।ওখান থেকে ফিরে আমরা বশিষ্ঠ মন্দির ও নবগ্রহ মন্দিরে গেলাম।বশিষ্ঠ মন্দিরের পিছনে অবস্থিত পাহাড়ী, ছোটো ঝরণা টি মন্দিরটিকে আলাদা সৌন্দর্য দান করেছে।নবগ্রহ মন্দিরটিতে প্রচুর বাঁদরের সমাগম দেখলাম।আমার চারবছরের কন্যা একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু একই রকম ভাবে দেখলাম ওরা ও বেশ শান্তিপ্রিয়।আমরা অধিকাংশ মানুষই শান্তির পূজারী, কিন্তু কিছু কিছু মানুষ এর ব্যতিক্রম।আর সব সমস্যা তাদের ই অবদান।
পরের দিন সকাল সকাল আমরা গেলাম নীল পর্বতে কামাখ্যা মায়ের দর্শনে।নির্বিঘ্নে পূজা হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে কাজিরাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।রাস্তার দু’পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়।আর অপূর্ব সেই রাস্তা। এমন রাস্তায় চলাচলে কষ্ট কিছুই নেই। এর জন্য আসাম সরকারকে সাধুবাদ দিতেই হয়।প্রায় 225km রাস্তা আমরা তিন ঘণ্টাতেই পৌঁছে গেলাম।আমাদের ড্রাইভার দীনেশ বাবু মানুষ টি ও স্বল্প ও মিষ্টভাষী।কাজিরাঙ্গা প্রবেশের মুখে এক জায়গায় দলবদ্ধ হরিণের পাল দেখে মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল।ওই রাস্তার ধারে ধারে সাইনবোর্ডে Animal's Corridor লেখা দেখে স্পষ্ট বুঝলাম আমরা ওদের রাজ্যে প্রবেশ করেছি।দীনেশদার মুখেই আসামের ভয়াবহ বন্যাবন্যার কথা শুনলাম।প্রতি বছর বর্ষায় এই বন্যা য় জঙ্গলেজঙ্গলের বাসিন্দাদের কষ্টের শেষ থাকে না।যে কোন জঙ্গল ই ভ্রমণার্থীদের জন্য বর্ষায় বন্ধ থাকে। কাজিরাঙ্গা ও তার ব্যতিক্রম নয়।
কাজিরাঙ্গা য় আমাদের বাসস্থানটি ছিল খুবই প্রাচীন ও ঐতিহ্যমন্ডিত ।কাজিরাঙ্গার সব থেকে প্রাচীন এই হোটেল ওয়াইল্ড গ্রাস (Wild Grass) আরণ্যক পরিবেশে অবস্থিত।কাজিরাঙ্গার বিখ্যাত এলিফ্যান্ট গ্রাস এর কথার প্রতিফলন পাই, আমাদের কাজিরাঙ্গা ভ্রমণের বাসস্থান হোটেলটির নামকরণে।
কাজিরাঙ্গা বাসের দ্বিতীয় দিনেদিনের ভোরে আমরা Elephant Safari এর অনবদ্য অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলাম।সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। আমার ছোট্ট মেয়ে পুপে একটু ও ভয় না পেয়ে অনাবিল আনন্দ পেলো হাতির পিঠে চড়ে।আমাদের হস্তিনীটির নাম ছিল পূর্ণিমা। পূর্ণিমার পিঠে আসীন হয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করে দেখলাম গন্ডারের ভান্ডার। তৃণভোজী এই প্রাণীটি বড়ই ঠাণ্ডা প্রকৃতির, কিন্তু শুনলাম রেগে গেলে স্বয়ং বাঘ মামা ও এদের সমঝে চলেন।ওই দিনে দুপুরে আবার গেলাম জঙ্গলের অন্দর মহলে। এবার Jeep Safari ।আমাদের এবারের ড্রাইভার আলী ভাই ছিলেন বেশ নির্ভীক, অভিজ্ঞ ও অল্প কথার মানুষ।যাত্রার শুরুতে ই বলেছিলেন যে বাঘমামার দর্শন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।অহেতুক আশা দেননি আর চেষ্টার যে ত্রুটি করেননি , তার প্রত্যক্ষদর্শী স্বয়ং আমরা।
জঙ্গলে প্রবেশ করে ই দর্শন পেলাম রাজগোখরোর (King Cobra) সাথে। দূরে থাকলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।এমনিতেই সরীসৃপের প্রতি টান আমার একেবারেই নেই। নানা জাতের অসংখ্য হরিণ, পাখির দর্শন পেলাম। আর গন্ডারের কথা তো বলা ই বাহুল্য। বিখ্যাত ELephant Grass এর মধ্যে বাঘ মামা আত্মগোপন করে আছেন না নেই সেই যে অনুভূতি, তার ব্যাখ্যা জঙ্গলের বাইরে এসে দেওয়া যায় না।বনমোরগ, নাম না জানা পাখি, বুনো শুয়োর, কচ্ছপ, বুনো মোষ, বাঁদর , বক সবার সাথেই দেখা হল।এক জায়গায় এসে আলী ভাই, গাড়ি থামিয়ে ইশারায় চুপ করতে বললেন।আমাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে নিচু গলায় বললেন যে Calling হচ্ছে, একটু খেয়াল রাখলে হয়তো বাঘমামা দর্শন দেবেন। সেই মূহুর্তটা ভুলব না। আমার কন্যা তখন ঘুমে কাদা !!!! আমি ভারি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।তখন আমার মন বলছে চিড়িয়াখানাতে ই বাঘ দেখা ভালো। সামনে দেখে কাজ নেই।আলীভাই আমাকে খুব সাহস দিলেন এই বলে যে, বাঘ মামাকে দেখতে পেলে ভাগ্নে ভাগ্নী সবার মনে সাহস এসে যায় ! কিন্তু দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য জানি না। কিছুক্ষণ পর আলীভাই বললেন যে Calling দূরে সরে যাচ্ছে।Tiger Calling ব্যাপারটা এবার জঙ্গল ভ্রমণে জানলাম নতুন করে। Tiger Calling এর অর্থ কিন্তু এমন নয় যে বাঘমামা ডাকছেন !! বাঘমামাকে কাছে পিঠে দেখতে পেলে Barking Deer যেমন ডাকে, একই ভাবে বাঁদর হনুমান ও মুখে একধরনের শব্দ করে বাকি জীবজন্তুকে সতর্ক করে দেয়, সেটাকেই বলে, Tiger Calling বা Calling, এটি সত্যিই আমাদের lifetime অভিজ্ঞতা।
এই মরসুমে সমস্ত তৃণভূমি বর্তমান থাকে না।জঙ্গলের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে, Elephant Grass পুড়িয়ে ফেলা হয়, কারণ এই ঘাস শুকিয়ে গেলে তৃণভোজীদের খাদ্য সমস্যা দেখা হয়।শুকনো তৃণভূমি পুড়িয়ে , সব পরিষ্কার করে দিলে তবেই নতুন তৃণভূমি মাথা তুলে দাঁড়াবে, জাগাবে তৃণভোজী প্রাণীদের আহার। আমরা কিছু কিছু জায়গায় এই Elephant Grass দেখেছি। কিছু ক্যামেরা বন্দি ও করেছি।আবার বহুস্থানে দেখেছি দগ্ধ তৃণভূমি।তবে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা অনবদ্য।আর নানা স্থানে ছোট, বড় জলাশয়, দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমি।অগুন্তি গণ্ডার। নিরীহ এই প্রাণীটি যেন ক্যামেরা বন্দি হওয়ার জন্যই প্রস্তুত সর্বদা।মাঝে একবার আকাশ জুড়ে মেঘ করে বৃষ্টি নামল জঙ্গলের ওপর।তার সৌন্দর্য ও অন্যরকম।প্রকৃতির নানা রূপ মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল আমাদের।ঠাণ্ডা হাওয়ায় এক সময় বেশ শীত শীত করছিল। দিনের শেষে যখন জঙ্গল থেকে ফিরছিলাম, মন তখন কানায় কানায় পূর্ণ।অদ্ভুত ভালোলাগায় অভিভূত আমরা সকলেই।মনে হচ্ছিল শুধু ক্যামেরা নয়, মনের ক্যামেরাতেও বন্দী করে নিয়ে চলেছি অনেক মূল্যবান সম্পদ।যার কোনো তুলনাই হয় না।
এই জঙ্গলের তিনটি ভাগ আছে।Elephant Safari হয় Western Range এ।Jeep Safari হয় Central ও Eastern Range-এ।সব কটি Range-ই গণ্ডার পরিপূর্ণ। তবে Central Range বিখ্যাত বাঘের জন্য এবং Eastern Range প্রসিদ্ধ নানা জাতের পাখির জন্য। কাজিরাঙ্গা ছাড়াও আসামের অন্যতম বিখ্যাত জঙ্গল হল মানস।মানসের খানিকটা অংশ আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল এ অবস্থান করে।পরের দিন সকালে আমাদের হোটেল সংলগ্ন গাছে ধানেশ পাখি (Horn Bill)এর দর্শন পেলাম।হোটেলের এক কর্মচারীর মুখেই শুনলাম এক ধানেশ দম্পতির বাসা ওই গাছটিতে-ই।
আমাদের এর পরের গন্তব্য ছিল মেঘালয়ের রাজধানী শিলং।আমরা গৌহাটি ফেরার পথে ওখানকার চিড়িয়াখানা যেটি open zoo সেটি ও দেখে নিলাম।রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালোই।গৌহাটি হয়ে আমরা শিলং যাত্রা করলাম তার পরের দিন।আমার স্বপ্নের শিলং পাহাড়।গৌহাটি থেকে 8 km, দু/আড়াই ঘন্টা মত সময় লাগে শিলং পৌছাতে।।আমরা সকালের জলখাবার খেয়ে নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম।শিলং পৌঁছলাম বিকেলের দিকে ।পাহাড়ী রাস্তা এত প্রশস্ত খুব একটা দেখিনি।মসৃণ রাস্তা বেশ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন।পাহাড়ী রাস্তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনবদ্য।ভাষায় তার ব্যাখ্যা করতে আমি অপরাগ।
শিলং প্রবেশের আগে পড়ল উমিয়াম লেক। বিশাল তার ব্যাপ্তি। লেকটি লোকমুখে প্রসিদ্ধ বড়াপাণী নামে।পাইন গাছের সারির মাঝে পরিবেশ নয়নাভিরাম।বড়াপাণীর ধারে অবস্থিত অর্কিড লেক ভিউ রির্সটে আমরা সেদিনের মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম।
আমাদের ভ্রমণের মধ্যে খাওয়ার ব্যাপারটা যদিও মুখ্য নয়, কিন্তু ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী যে গদ্যময় সে কথা আমরা সকলেই জানি। আসামের খাবারে তেল মশলা পরিমিত, সহজসাধ্য, হাল্কা খাবার। বাঙালি খাবারের সাথে আলাদা করা যায় না।খেয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। আসামের , মাছের একটা preparation এর কথা শুনেছিলাম। টমেটো দিয়ে তৈরী মাছের পদটি নাকি খেতে ভারি সুন্দর। দুর্ভাগ্য বশত সেই পদটির স্বাদ গ্রহন করা হয়নি। পদটির নাম ট্যাঙা । 'ট্যাঙা' শব্দটি আসামী শব্দ, এর অর্থ 'টক্'।
শিলং এ আমরা ছিলাম ব্রাক্ষসমাজ অতিথি শালায়।আমার কন্যার চিকিৎসক এবং আমার স্বামীর সহকর্মী সঙ্গীতাদির জন্ম এই শিলং-এ।আমাদের আসাম যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে-ই সঙ্গীতাদি অত্যন্ত উৎসাহ ও আনন্দের সাথে tour plan ছকে দিয়েছিলেন।বড়দির মতো, প্রতি মুহূর্তে, খোঁজ খবর নিয়েছেন আমাদের।
শিলং বেশ ঠান্ডা। কলকাতায় আমরা শীতকালকে প্রায় ভুলতে বসেছি।শীতের রোদের আমেজ মনে হয় অলীক কল্পনা।কিন্তু শিলং এ পৌঁছে বেশি ঠাণ্ডায় প্রথমে একটু ধাতস্থ হতে সময় লাগল।পরে ঠান্ডাকে বেশ উপভোগ্য মনে হল।ব্রাক্ষসমাজ অতিথিশালা শিলং এর অন্যতম প্রাণকেন্দ্র পুলিশ বাজার এর মোড়ে।জায়গাটি জনসমাগমে পরিপূর্ণ।
অতিথিশালায় খাবারের কোনো বন্দোবস্ত না থাকায়, আমাদের খেতে যেতে হতো অন্যত্র।পাহাড়ী অঞ্চলে রাতের নিস্তব্ধতা দ্রুত নেমে আসে, নগরী ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়।তাই শিলং থাকাকালীন , আমরা সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ নৈশ আহার করতে বেরিয়ে পড়তাম।বাঙালি খাবার এখানে সহজলভ্য।শিলং বাঙালি অধ্যুষিত।একসময় প্রচুর বাঙালির বাসস্থান ছিল, পরবর্তী কালে কিছু অসন্তোষের জন্য অনেক বাঙালি পরিবার শিলং ত্যাগ করেন, কিন্তু তা ও বাঙালির সংখ্যা ওখানে নেহাত কম নয়।রাত্রে খাবার খেয়ে অতিথিশালায় ফিরে ঠাণ্ডায় লেপের ওমের মধ্যে যখন আমরা নিজেদের সঁপে দিলাম, ঠান্ডার আমেজে সারা শরীর মন যেন জুড়িয়ে গেল।
শিলং ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে আমরা গেলাম চেরাপুঞ্জীর কিছু দর্শনীয় স্থানে।যাত্রা পথে আমাদের এবারের সঙ্গী জাকির ভাই।এ মানুষটি ও বেশ ভালো।জলখাবার খেয়ে যাত্রা করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আমরা চেরাপুঞ্জী প্রবেশ করলাম।তারপর শুরু হল একে একে না না জলপ্রপাত দর্শন।এই ঝরণা গুলির ক্ষীণকায়া দেখে মন যে খুব ভরল বলা যায় না।জাকির ভাই বললেন যে বর্ষাকালে এই সব পাহাড়ী ঝোরা জল ঝরিয়ে, জল ছড়িয়ে নেচে নেচে সশব্দে যখন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামে, সে রূপ দেখার মতো।তখন আর সেই ঝরণা শীর্ণকায়া নয়।রীতিমতো যৌবনোচ্ছল তার রূপ।সে বর্ণনায় মুখর হবেন কবি।তবে জাকির ভাই একথা ও বললেন এ সময়ের মতো গাড়ি থেকে নেমে দর্শনের সৌভাগ্য বর্ষাকালে সর্বদা হয় না, বৃষ্টির প্রাবল্যে।তবে মেঘের আলয় এই মেঘালয় বর্ষাকালে মেঘ বৃষ্টি খেলা করে অহরহ।পর্যটকরা মেঘবালিকাদের সাথে লুকোচুরি খেলার সুযোগ পায়।আমরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম।
নানা view point এর মধ্যে প্রায় সর্বত্র-ই খাসী পোশাক পরে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে।এক জায়গায় আমার কন্যা পাহাড়ী পোশাক পরে ছবি তুলল।এরপর আমরা পৌঁছলাম Mawdok view point।শীর্ণকায়া কয়েকটি পাহাড়ী ঝোরার দর্শন মিলল।এখান থেকে একটু এগিয়ে পাহাড়ী পথে একটি Eco Park রয়েছে। সেখান থেকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ দেখা যায়।পার্কটি সুন্দর করে সাজানো।বাচ্চাদের উপযোগী দোলনা, স্লিপ অনেক কিছুই সেখানে ছিল।পাহাড়ী পথে মাঝে মাঝেই দেখতে পাচ্ছিলাম খ্রীষ্টান সমাধি ক্ষেত্র।এখানে বেশ কিছু অঞ্চল খ্রিস্টান অধ্যুষিত।এরপর একে একে ওই পথে পড়ল Wah Kaba Falls, রামকৃষ্ণ মিশন, Non Kai Kai Falls ইত্যাদি।শীর্ণকায়া ঝরণাগুলি মন খুব ভরাতে না পারলেও আমাদের বেড়ানোর আনন্দে কোনো ঘাটতি ছিল না।আরো কিছু পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম Mowsmai Cave এ।দীর্ঘ দিনের বৃষ্টিপাতের জল চুইয়ে গুহার ভিতরে প্রবেশ করে, গুহার পাথরে(Lime stone) নানা ধরনের আকারআহার তৈরি হয়েছে। গুহা বেশি বড় নয়, ঢোকার রাস্তা ও বেরনোর রাস্তা পৃথক।মধ্যের বেশিরভাগ রাস্তা প্রায় বুকে হেঁটে অগ্রসর হতে হয়।অন্যান্য পর্যটকদের মুখে শুনে আমরা গুহার মধ্যে অগ্রসর না হয়ে ফিরে এলাম।খুব অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি আমাদের দুজনেরই একটু বিরূপতা আছে।যদি এই অ্যাডভেঞ্চারের দরূণ আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হয়, সে আমাদের কখনোই কাম্য নয়।সুতরাং আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে Seven sister falla বা Mawsmai falls দেখে, ফেরার পথে একটি vegetarian hotel এ মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম।
ফেরার পথে আমরা দেখলাম বিখ্যাত ELephant Falls। এই ঝরণা দেখার জন্য প্রায় দুশো (175) সিড়ি নামতে হয়।কিন্তু তারপর সত্যিই কোন আফসোস থাকেনি।সত্যিই মনে হয়েছে যে, ঝরণা কে নিয়ে মুগ্ধ গুরূদেবের বর্ণনা স্বার্থক "ঝরণা ঝরণা সুন্দরী ঝরণা, তরলিত চন্দ্রিকা চন্দন বর্ণা......."।প্রথম দেখলাম "শেষের কবিতা'র বর্ণনা সমৃদ্ধ "উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ"।কী অপরূপ যে তার উপস্থিতি ! রাস্তার দু’পাশের গাছগুলো যেন আলো করে রেখেছে রোডোডেনড্রন পুষ্পের রাশি।ফেরার পথে এক জায়গায়, গাড়ি থামিয়ে, নেমে রডোডেনড্রন ফুলে ভরা গাছের ছবি ক্যামেরা বন্দি করলাম। দিনের আলো কমে এসেছিল। কিন্তু তা ও ছবি নিলাম। এরপর অতিথি শালায় ফেরার পথে গেলাম শিলং এর বিখ্যাত ক্যাথিড্রাল চার্চ, যা শুনলাম এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম।আমরা যখন চার্চে পৌঁছলাম, তখন প্রার্থনা সঙ্গীত শুরু হতে চলেছে। অল্পক্ষণ প্রার্থনা গৃহে বসলাম। শান্ত, সমাহিত পরিবেশ মনকে ছুঁয়ে যায়। সন্ধ্যার আলোয় সাজানো মা মেরী ও যীশুর মূর্তি সত্যিই অসাধারণ।ওখানে কিছুক্ষন কাটিয়ে অতিথিশালায় ফিরে এলাম।
পরের দিন আমাদের আরো কিছু দর্শনের ইচ্ছা নিয়ে আমরা রওনা দিলাম সকালে। জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে, প্রথমে গেলাম শিলং শহরের মধ্যে অবস্থিত হয়দরি পার্ক-এ।পার্কটি র বিশেষত্ব এই যে, এখানে ছোট্ট একটি চিড়িয়াখানার দর্শন পেলাম।সেখানে নানা ধরনের পাখির সাথে সাথে বেশ কিছু পশুর দেখাও পেলাম।যেমন-মেঘলা চিতা, পাহাড়ী ভল্লুক, পাহাড়ী শকুন, বেবুন , হরিণ, পাখি ইত্যাদি।রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালো। এই পার্কের ফুলের সমাহার ও অসাধারণ। এখানে থেকে গেলাম শিলং থাকাকালীন কবিগুরুর বাসস্থানটিতে ।তখন এটি ছিল রাণী চন্দের বাসস্থান। কবিগুরু শিলং এ ওঁনার বাড়িতেই থাকতেন।বহু বছর মালিকানা বদল হয়েছে।বর্তমান মালিক অনত্র থাকেন।বাড়িটি তালা বন্ধ। প্রধান ফটকের কাছে একটি শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা রয়েছে কবির কথা।তিনি এই বাড়িতে বসে অনেক রচনায় আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হল "রক্তকরবী"।সেটির উল্লেখ রয়েছে ওই ফলকটিতে ।কবির ব্যবহৃত আসবাবপত্র রাখা আছে কাছেই অ্যাসেমব্লীর পাশে অবস্থিত রবীন্দ্র মিউজিয়ামে।সেখানে মেঘালয় সরকারের পক্ষ থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা স্বরূপ রয়েছে কবিগুরুর একটি মূর্তি।এসব-ই পর্যটকদের দেখার জন্য রাখা হয়েছে।বিধান সভার অধিবেশন চলার দরূণ মিউজিয়ামটি বন্ধ ছিল, দেখার সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারলাম না।এই আফসোস নিয়েই আমরা ওখান থেকে, অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
এবারের গন্তব্য শিলং পীক্।শিলং এর সর্বোচ্চ স্থান এটি। এখানে একটি পার্ক রয়েছে আর দুটি Watch tower, যেখান থেকে পুরো শিলং শহরটিকে ছবির মত দেখায়।এই অঞ্চলটি সেনাবাহিনীর এলাকার মধ্যে।প্রবেশ করার সময় আমাদের পরিচয় পত্র দাখিল করতে হয়েছিল।ফেরার সময় সে সব ফেরৎ পেলাম।
এরপরের গন্তব্য এশিয়ার পরিষ্কারতম গ্রাম।নাম মওলীনন্যং , পৌঁছাতে অনেকখানি সময় কেটে গেল, ওই গ্রামে প্রবেশের আগেই আমরা দেখতে গেলাম বিখ্যাত Root bridge টি।পথে শুনলাম চেরাপুঞ্জীতে অনুরূপ আরো একটি Root bridge আছে, যেটা ডবলডেকার ব্রীজ। এটিতে পৌছানোর রাস্তা বেশ দুর্গম,3700 টি সিড়ি নীচে নেমে পৌঁছতে হয়।
প্রকৃতির কি বিচিত্র এ লীলা।ছেলেবেলায় আমরা অরণ্যদেবের গাছ বাড়ির গল্প পড়ে মুগ্ধ হতাম।এখানে সত্যিকারের গাছের শিকড় দিয়ে তৈরী ব্রীজ দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম।এই ব্রীজ দেখার জন্য অনেকগুলি সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হলো, গাছের পাতার ছায়ায় ওই রাস্তায় সূর্যের আলো ভালো প্রবেশ করে না।পরিবেশ একটু ভিজে ভিজে , স্যাঁতস্যাতে , সেই সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকার সঙ্গত যেন জায়গার মাধুর্যে আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে।এই ঝিল্লিরব শুনেই বোধহয় কবি ও লেখকের লেখনী সচল হয়েছে। নীচে কিছু দূর অবধি বাঁধানো সিড়ি থাকলেও, বাকী রাস্তা শুধু ইঁট পেতে সিড়ির আকারে দেওয়া হয়েছে। পথে বহু দেশবিদেশী পর্যটকের ভিড় দেখলাম। Root bridge এর নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে নাম না জানা একটি ক্ষীণধারা।ওখান থেকে ফিরে আমরা মওলীনন্যং গ্রামে আমাদের দ্বিপ্রহরিক আহার সম্পন্ন করলাম।এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রামে পর্যটকরাও যেন তার পরিচ্ছন্নতা বজায় না রেখে পারে না। আমরা সকলেই বেশ ক্ষুধার্ত ছিলাম। আমরা ধূমায়িত ভাত, ডাল, আলুভাজা ও পাহাড়ী মুরগির ঝোল আর স্যালাড সহযোগে খাওয়া শেষ করলাম। অপূর্ব সে রান্নার স্বাদ।এখানে দেখলাম খাবারের হোটেল গুলি সব কটি-ই মহিলাদের দ্বারাই চালিত।হোটেলের মালিক, ম্যানেজার, পরিবেশনরত কর্মী সকলেই মহিলা। এই গ্রামে অল্প কিছু বেতের পসরা সাজানো দোকান ও দেখলাম, যেগুলিতে প্রধানত পর্যটকদের -ই ভিড়।গ্রামের পরিচ্ছন্ন রাস্তার দুধারে অবস্থিত প্রতিটি বাড়িতে সুন্দর করে ফুলের বাগান করা হয়েছে।সত্যিই এর পরিচ্ছন্নতা মনকে ভরিয়ে তোলে, ভালো লাগায়।
ওখানে আরো একটু থাকার ইচ্ছা দমন করে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় Balancing Rock দেখে ওখানে থেকে আমরা রওনা দিলাম ইন্দো বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত ডাওকী গ্রামের উদ্দেশ্যে।ওই রাস্তায় বড় একটি ঝরণার দর্শনে মন প্রাণ ভরে গিয়েছিল।আমরা বর্ষাকালে মেঘের দেশে ভ্রমণে যাইনি, সুতরাং শীর্ণকায়া ঝরণার দর্শনে মন বিশেষ ভরেনি, সব চাওয়া মেটে না কখনোই।কিন্তু ডাওকী যাওয়ার পথে বোরো ফলস্ এ সে আফসোস অনেকখানি দূর হোলো। আমরা ওই জলপ্রপাতের সামনে বেশ কিছুক্ষন অতিবাহিত করলাম।ডাওকী যাওয়ার পাহাড়ী পথের ধারে ধারে সুপুরি গাছের ভিড়ের ফাঁক দিয়ে প্রতিবেশী ওপার বাংলা দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল।আমাদের ড্রাইভার জাকির ভাই-এর কাছেই শুনলাম যে ওনার আদি দেশ ওপারে-ই। বহু বছর আগে ওনার বাবা এদেশে চলে আসেন।এখনো ওনাদের কিছু আত্মীয় স্বজন ওদেশে-ই রয়ে গেছেন।এপারে ভারতের ডাওকী, ওপারে বাংলাদেশের সিলেট।ওখানে আমরা একটি নাম না জানা পাহাড়ী নদীর সেতু পার হলাম।সেতুর পাশের ফলক ব্রিটিশ যুগের সাক্ষ্য বহন করছে। এই সেতু পেরিয়ে খানিকটা গেলেই দুই দেশের চেকপোস্ট। আমরা দূর থেকে তা দেখে ফেরার পথে নাম না জানা পাহাড়ী নদীর তটভূমিতে সূর্যাস্ত দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।তটভূমিতে নুড়ি বেছানো পথে নদীর ধারে গিয়ে স্বচ্ছ জলের ধারা দেখলাম। ওখানে এক ঘন্টা করে নৌবিহারের ব্যবস্থা থাকলেও, সন্ধ্যা প্রায় আগত, তাই ইচ্ছায় লাগাম দিলাম।ওপারে আমাদের সেই চিরপরিচিত বাংলাদেশ।কত কাছের, কিন্তু কত দূর ! এই দূরত্ব মেটার নয়।নদীর ধারে খুচরো কিছু বিক্রেতা আচার, ঝালমুড়ি নিয়ে পশরা সাজিয়েছে।তাদের কথার টান শুনে বুঝতে অসুবিধা হলো না, যে তারা সকালে এদেশে ব্যাবসা করতে আসে।দিনান্তে নিজের দেশে, নিজের ঘরে ফিরে যায় নদী পেরিয়ে।ক্ষুদ্র ব্যাবসা দেশকালের গণ্ডী ছাড়িয়ে গেছে দেখে বেশ ভালো লাগলো, একটু মজা ও লাগলো।ফেরার পথে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল।সামনেই দোলপূর্ণিমা ছিল, তাই জ্যোৎস্না স্নাত পাহাড়ী পথ সম্পূর্ণ নতুন রূপে ধরা দিল দৃশ্যপটে।
কিন্তু সমতলের বাসিন্দা আমরা, ওই নিঝুম, নিস্তব্ধ, পাহাড়ী পথে রাতের অন্ধকারে বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।জাকির ভাই বোধহয়, আমাদের সেই আতঙ্কিত মনোভাব বুঝতে পেরে নানা ধরণের গল্পের মাঝে আমাদের আতঙ্ক কাটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।একসময় শহরে পৌঁছলাম।তখন সারাদিনের বেড়ানোর ফলে আমরা পরিশ্রান্ত, কিন্তু মন পরিপূর্ণ কানায় কানায়।
পরের দিন আমাদের ঘরে ফেরার পালা।কিন্তু সকালে অল্পসল্প কেনাকাটা সেরে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত ওয়ার্ডস লেক (Wards Lake) দেখতে চলে গেলাম।লেক সংলগ্ন পার্কে নানা ফুলের সমাহার ঋতুরাজের আগমন বার্তা ঘোষণা করছে। লেকের জলে নৌবিহারের ব্যবস্থা থাকলেও, সেটির সময় আরো একটু বেলায়।।আমরা ওখান থেকে ফিরে তৈরি হয়ে, গৌহাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।রাস্তায় এক জায়গায় দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।বিকেল নাগাদ গৌহাটি পৌছে গেলাম।মনকে নিজেরাই বললাম, আবার আসব ব্রক্ষ্মপুত্রের ধারের এই সুন্দর শহরে।মন একটু বিষন্ন হলেও, অনেকদিন নিজের ঘর ছেড়ে থাকার দরুন, মনে হল আমার প্রিয় শহরের আমাদের বাসাবাড়িটি যেন আমাদের আকুল ভাবে ডাকছে।বলছে, এবার তোমরা ঘরে ফিরে এসো।
সে ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা মনে মনে গেয়ে উঠলাম--"মন চলো নিজ নিকেতনে"।।
ভ্রমণ বিষয়টিতে এক সময় বাঙালির একচেটিয়া অধিকার ছিল।এখন শুধু বাঙালি নয়, ভ্রমণে উৎসাহী জনতার মধ্যে অন্যান্য প্রদেশের মানুষ ও সামিল হয়েছেন।তবে যাই হোক না কেন বাঙালির নাম এখনও ভ্রমণ পিপাসুদের তালিকার শীর্ষে-ই রয়েছে।
অজ্ঞানত আমার প্রথম ভ্রমন দীঘা।সে ভ্রমণের গল্প আমার মায়ের মুখেই শোনা।সে ভ্রমণের গল্প মায়ের মুখে ই শোনা।মনে নেই সেই ছোট্ট বেলার প্রথম সমুদ্র দর্শন। পরবর্তী দীর্ঘ ভ্রমণ ছিল Travel Agency র মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভ্রমণ, ইতিহাসের প্রাণকেন্দ্র রাজস্থানে।ইতিহাস চিরকাল ই আমার খুব প্রিয় বিষয়, তাই এই ভ্রমণ ছিল ইতিহাস কে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা।
আমার মায়ের ছিল ভ্রমণের শখ্, কিন্তু অনুকূল পরিবেশ, পরিস্থিতির অভাবে তা নেশায় পরিণত করার সৌভাগ্য ঘটেনি।কিছু কিছু ভ্রমণের গল্প শুনেছি মায়ের কাছে।সেই সব গল্প শুনেই ভ্রমণে র প্রতি আগ্রহের সঞ্চার হয় আমার মনে। আগ্রহ হলেও অজ্ঞাত কে জানার, চেনার এক অহেতুক ভীতি ও তখন কাজ করত। কিন্তু সেই ভীতি একটু একটু করে কেটে গেল আমার বিয়ের পর।কারণ বিয়ের পর একটা নতুন ভ্রমণ পিপাসু বন্ধু পেলাম যে !!!!
কিছু ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলেও অনেক রয়েছে বাকি।আমাদের ভারতবর্ষের মধ্যে ভ্রমণের স্নানের অভাব নেই।এমনকি সত্যি বলতে কি এক জীবনে দেখে শেষ করা যায় না, প্রকৃতির এই অফুরন্ত ভাণ্ডার। কী নেই এখানে ? মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো পর্বতমালা, ফেনিল, সুনীল সমুদ্র, হ্রদ, নিবিড় অরণ্যভূমি , উষর মরুভূমি , নদী, হিমবাহ, জলপ্রপাত, ঝরণা, প্রাকৃতিক বন্দর, ঐতিহাসিক কাহিনী সমৃদ্ধ দূর্গ, রাজপ্রাসাদ , গুহামন্দির, অনবদ্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সমৃদ্ধ মন্দির, গীর্জা, মসজিদ।
২০১৭ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা গিয়েছিলাম উত্তর-উত্তরপূর্ব ভারতের কয়েকটি অঞ্চল ভ্রমণে।আমাদের গন্তব্য ছিল আসামের শহর গৌহাটি ও অরণ্য ভূমি কাজিরাঙা এবং মেঘালয়ের প্রসিদ্ধ কয়েকটি অঞ্চল ও মেঘালয়ের রাজধানী, কবিগুরুর "শেষের কবিতা খ্যাত শিলং।
গৌহাটি শহরটি বেশ সুন্দর।সব থেকে সুন্দর লাগলো ওখানকার বাসিন্দাদের।খুব সহজ সরল, শান্তিপ্রিয় বলেই বোধ হল।আসামের বাসিন্দা সংক্রান্ত অহেতুক ভীতি কিছুটা হলেও দূর হল এদের সহজ সরল ব্যবহারে।শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রক্ষ্মপুত্র নদ, শহরের সৌন্দর্যকে যেন অনেকঅনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে।শহরের এক পাশে আছে ছোট্ট অরণ্য পবিতোরা।সেখানে ঘটে বহু পরিযায়ী পাখির সমাবেশ। ব্রক্ষ্মপুত্র নদের মধ্যের একটি দ্বীপে আছে উমানন্দ মহাদেবের মন্দির।নৌকা করে সেখানে যেতে হয়।খরস্রোতা ব্রক্ষ্মপুত্র পেরিয়ে সেই মন্দির চত্বরে যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল হয়ে এসেছে।শান্ত পরিবেশ মনকে মুগ্ধ করে। ভক্ত সমাগম থাকলেও সবাই খুবই শান্তিপ্রিয়।হয়তো পরিবেশের মাহাত্ম্য ও আছে। তখন শান্ত পরিবেশে ভক্ত গণ ও যেন নিরবে নিভৃতে ভগবানের কাছে আর্তি জানায়।ওখান থেকে ফিরে আমরা বশিষ্ঠ মন্দির ও নবগ্রহ মন্দিরে গেলাম।বশিষ্ঠ মন্দিরের পিছনে অবস্থিত পাহাড়ী, ছোটো ঝরণা টি মন্দিরটিকে আলাদা সৌন্দর্য দান করেছে।নবগ্রহ মন্দিরটিতে প্রচুর বাঁদরের সমাগম দেখলাম।আমার চারবছরের কন্যা একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু একই রকম ভাবে দেখলাম ওরা ও বেশ শান্তিপ্রিয়।আমরা অধিকাংশ মানুষই শান্তির পূজারী, কিন্তু কিছু কিছু মানুষ এর ব্যতিক্রম।আর সব সমস্যা তাদের ই অবদান।
পরের দিন সকাল সকাল আমরা গেলাম নীল পর্বতে কামাখ্যা মায়ের দর্শনে।নির্বিঘ্নে পূজা হয়ে যাওয়ার পর আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে কাজিরাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।রাস্তার দু’পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়।আর অপূর্ব সেই রাস্তা। এমন রাস্তায় চলাচলে কষ্ট কিছুই নেই। এর জন্য আসাম সরকারকে সাধুবাদ দিতেই হয়।প্রায় 225km রাস্তা আমরা তিন ঘণ্টাতেই পৌঁছে গেলাম।আমাদের ড্রাইভার দীনেশ বাবু মানুষ টি ও স্বল্প ও মিষ্টভাষী।কাজিরাঙ্গা প্রবেশের মুখে এক জায়গায় দলবদ্ধ হরিণের পাল দেখে মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল।ওই রাস্তার ধারে ধারে সাইনবোর্ডে Animal's Corridor লেখা দেখে স্পষ্ট বুঝলাম আমরা ওদের রাজ্যে প্রবেশ করেছি।দীনেশদার মুখেই আসামের ভয়াবহ বন্যাবন্যার কথা শুনলাম।প্রতি বছর বর্ষায় এই বন্যা য় জঙ্গলেজঙ্গলের বাসিন্দাদের কষ্টের শেষ থাকে না।যে কোন জঙ্গল ই ভ্রমণার্থীদের জন্য বর্ষায় বন্ধ থাকে। কাজিরাঙ্গা ও তার ব্যতিক্রম নয়।
কাজিরাঙ্গা য় আমাদের বাসস্থানটি ছিল খুবই প্রাচীন ও ঐতিহ্যমন্ডিত ।কাজিরাঙ্গার সব থেকে প্রাচীন এই হোটেল ওয়াইল্ড গ্রাস (Wild Grass) আরণ্যক পরিবেশে অবস্থিত।কাজিরাঙ্গার বিখ্যাত এলিফ্যান্ট গ্রাস এর কথার প্রতিফলন পাই, আমাদের কাজিরাঙ্গা ভ্রমণের বাসস্থান হোটেলটির নামকরণে।
কাজিরাঙ্গা বাসের দ্বিতীয় দিনেদিনের ভোরে আমরা Elephant Safari এর অনবদ্য অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলাম।সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। আমার ছোট্ট মেয়ে পুপে একটু ও ভয় না পেয়ে অনাবিল আনন্দ পেলো হাতির পিঠে চড়ে।আমাদের হস্তিনীটির নাম ছিল পূর্ণিমা। পূর্ণিমার পিঠে আসীন হয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করে দেখলাম গন্ডারের ভান্ডার। তৃণভোজী এই প্রাণীটি বড়ই ঠাণ্ডা প্রকৃতির, কিন্তু শুনলাম রেগে গেলে স্বয়ং বাঘ মামা ও এদের সমঝে চলেন।ওই দিনে দুপুরে আবার গেলাম জঙ্গলের অন্দর মহলে। এবার Jeep Safari ।আমাদের এবারের ড্রাইভার আলী ভাই ছিলেন বেশ নির্ভীক, অভিজ্ঞ ও অল্প কথার মানুষ।যাত্রার শুরুতে ই বলেছিলেন যে বাঘমামার দর্শন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।অহেতুক আশা দেননি আর চেষ্টার যে ত্রুটি করেননি , তার প্রত্যক্ষদর্শী স্বয়ং আমরা।
জঙ্গলে প্রবেশ করে ই দর্শন পেলাম রাজগোখরোর (King Cobra) সাথে। দূরে থাকলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।এমনিতেই সরীসৃপের প্রতি টান আমার একেবারেই নেই। নানা জাতের অসংখ্য হরিণ, পাখির দর্শন পেলাম। আর গন্ডারের কথা তো বলা ই বাহুল্য। বিখ্যাত ELephant Grass এর মধ্যে বাঘ মামা আত্মগোপন করে আছেন না নেই সেই যে অনুভূতি, তার ব্যাখ্যা জঙ্গলের বাইরে এসে দেওয়া যায় না।বনমোরগ, নাম না জানা পাখি, বুনো শুয়োর, কচ্ছপ, বুনো মোষ, বাঁদর , বক সবার সাথেই দেখা হল।এক জায়গায় এসে আলী ভাই, গাড়ি থামিয়ে ইশারায় চুপ করতে বললেন।আমাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে নিচু গলায় বললেন যে Calling হচ্ছে, একটু খেয়াল রাখলে হয়তো বাঘমামা দর্শন দেবেন। সেই মূহুর্তটা ভুলব না। আমার কন্যা তখন ঘুমে কাদা !!!! আমি ভারি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।তখন আমার মন বলছে চিড়িয়াখানাতে ই বাঘ দেখা ভালো। সামনে দেখে কাজ নেই।আলীভাই আমাকে খুব সাহস দিলেন এই বলে যে, বাঘ মামাকে দেখতে পেলে ভাগ্নে ভাগ্নী সবার মনে সাহস এসে যায় ! কিন্তু দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য জানি না। কিছুক্ষণ পর আলীভাই বললেন যে Calling দূরে সরে যাচ্ছে।Tiger Calling ব্যাপারটা এবার জঙ্গল ভ্রমণে জানলাম নতুন করে। Tiger Calling এর অর্থ কিন্তু এমন নয় যে বাঘমামা ডাকছেন !! বাঘমামাকে কাছে পিঠে দেখতে পেলে Barking Deer যেমন ডাকে, একই ভাবে বাঁদর হনুমান ও মুখে একধরনের শব্দ করে বাকি জীবজন্তুকে সতর্ক করে দেয়, সেটাকেই বলে, Tiger Calling বা Calling, এটি সত্যিই আমাদের lifetime অভিজ্ঞতা।
এই মরসুমে সমস্ত তৃণভূমি বর্তমান থাকে না।জঙ্গলের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে, Elephant Grass পুড়িয়ে ফেলা হয়, কারণ এই ঘাস শুকিয়ে গেলে তৃণভোজীদের খাদ্য সমস্যা দেখা হয়।শুকনো তৃণভূমি পুড়িয়ে , সব পরিষ্কার করে দিলে তবেই নতুন তৃণভূমি মাথা তুলে দাঁড়াবে, জাগাবে তৃণভোজী প্রাণীদের আহার। আমরা কিছু কিছু জায়গায় এই Elephant Grass দেখেছি। কিছু ক্যামেরা বন্দি ও করেছি।আবার বহুস্থানে দেখেছি দগ্ধ তৃণভূমি।তবে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা অনবদ্য।আর নানা স্থানে ছোট, বড় জলাশয়, দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমি।অগুন্তি গণ্ডার। নিরীহ এই প্রাণীটি যেন ক্যামেরা বন্দি হওয়ার জন্যই প্রস্তুত সর্বদা।মাঝে একবার আকাশ জুড়ে মেঘ করে বৃষ্টি নামল জঙ্গলের ওপর।তার সৌন্দর্য ও অন্যরকম।প্রকৃতির নানা রূপ মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল আমাদের।ঠাণ্ডা হাওয়ায় এক সময় বেশ শীত শীত করছিল। দিনের শেষে যখন জঙ্গল থেকে ফিরছিলাম, মন তখন কানায় কানায় পূর্ণ।অদ্ভুত ভালোলাগায় অভিভূত আমরা সকলেই।মনে হচ্ছিল শুধু ক্যামেরা নয়, মনের ক্যামেরাতেও বন্দী করে নিয়ে চলেছি অনেক মূল্যবান সম্পদ।যার কোনো তুলনাই হয় না।
এই জঙ্গলের তিনটি ভাগ আছে।Elephant Safari হয় Western Range এ।Jeep Safari হয় Central ও Eastern Range-এ।সব কটি Range-ই গণ্ডার পরিপূর্ণ। তবে Central Range বিখ্যাত বাঘের জন্য এবং Eastern Range প্রসিদ্ধ নানা জাতের পাখির জন্য। কাজিরাঙ্গা ছাড়াও আসামের অন্যতম বিখ্যাত জঙ্গল হল মানস।মানসের খানিকটা অংশ আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল এ অবস্থান করে।পরের দিন সকালে আমাদের হোটেল সংলগ্ন গাছে ধানেশ পাখি (Horn Bill)এর দর্শন পেলাম।হোটেলের এক কর্মচারীর মুখেই শুনলাম এক ধানেশ দম্পতির বাসা ওই গাছটিতে-ই।
আমাদের এর পরের গন্তব্য ছিল মেঘালয়ের রাজধানী শিলং।আমরা গৌহাটি ফেরার পথে ওখানকার চিড়িয়াখানা যেটি open zoo সেটি ও দেখে নিলাম।রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালোই।গৌহাটি হয়ে আমরা শিলং যাত্রা করলাম তার পরের দিন।আমার স্বপ্নের শিলং পাহাড়।গৌহাটি থেকে 8 km, দু/আড়াই ঘন্টা মত সময় লাগে শিলং পৌছাতে।।আমরা সকালের জলখাবার খেয়ে নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম।শিলং পৌঁছলাম বিকেলের দিকে ।পাহাড়ী রাস্তা এত প্রশস্ত খুব একটা দেখিনি।মসৃণ রাস্তা বেশ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন।পাহাড়ী রাস্তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনবদ্য।ভাষায় তার ব্যাখ্যা করতে আমি অপরাগ।
শিলং প্রবেশের আগে পড়ল উমিয়াম লেক। বিশাল তার ব্যাপ্তি। লেকটি লোকমুখে প্রসিদ্ধ বড়াপাণী নামে।পাইন গাছের সারির মাঝে পরিবেশ নয়নাভিরাম।বড়াপাণীর ধারে অবস্থিত অর্কিড লেক ভিউ রির্সটে আমরা সেদিনের মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম।
আমাদের ভ্রমণের মধ্যে খাওয়ার ব্যাপারটা যদিও মুখ্য নয়, কিন্তু ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী যে গদ্যময় সে কথা আমরা সকলেই জানি। আসামের খাবারে তেল মশলা পরিমিত, সহজসাধ্য, হাল্কা খাবার। বাঙালি খাবারের সাথে আলাদা করা যায় না।খেয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। আসামের , মাছের একটা preparation এর কথা শুনেছিলাম। টমেটো দিয়ে তৈরী মাছের পদটি নাকি খেতে ভারি সুন্দর। দুর্ভাগ্য বশত সেই পদটির স্বাদ গ্রহন করা হয়নি। পদটির নাম ট্যাঙা । 'ট্যাঙা' শব্দটি আসামী শব্দ, এর অর্থ 'টক্'।
শিলং এ আমরা ছিলাম ব্রাক্ষসমাজ অতিথি শালায়।আমার কন্যার চিকিৎসক এবং আমার স্বামীর সহকর্মী সঙ্গীতাদির জন্ম এই শিলং-এ।আমাদের আসাম যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে-ই সঙ্গীতাদি অত্যন্ত উৎসাহ ও আনন্দের সাথে tour plan ছকে দিয়েছিলেন।বড়দির মতো, প্রতি মুহূর্তে, খোঁজ খবর নিয়েছেন আমাদের।
শিলং বেশ ঠান্ডা। কলকাতায় আমরা শীতকালকে প্রায় ভুলতে বসেছি।শীতের রোদের আমেজ মনে হয় অলীক কল্পনা।কিন্তু শিলং এ পৌঁছে বেশি ঠাণ্ডায় প্রথমে একটু ধাতস্থ হতে সময় লাগল।পরে ঠান্ডাকে বেশ উপভোগ্য মনে হল।ব্রাক্ষসমাজ অতিথিশালা শিলং এর অন্যতম প্রাণকেন্দ্র পুলিশ বাজার এর মোড়ে।জায়গাটি জনসমাগমে পরিপূর্ণ।
অতিথিশালায় খাবারের কোনো বন্দোবস্ত না থাকায়, আমাদের খেতে যেতে হতো অন্যত্র।পাহাড়ী অঞ্চলে রাতের নিস্তব্ধতা দ্রুত নেমে আসে, নগরী ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়।তাই শিলং থাকাকালীন , আমরা সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ নৈশ আহার করতে বেরিয়ে পড়তাম।বাঙালি খাবার এখানে সহজলভ্য।শিলং বাঙালি অধ্যুষিত।একসময় প্রচুর বাঙালির বাসস্থান ছিল, পরবর্তী কালে কিছু অসন্তোষের জন্য অনেক বাঙালি পরিবার শিলং ত্যাগ করেন, কিন্তু তা ও বাঙালির সংখ্যা ওখানে নেহাত কম নয়।রাত্রে খাবার খেয়ে অতিথিশালায় ফিরে ঠাণ্ডায় লেপের ওমের মধ্যে যখন আমরা নিজেদের সঁপে দিলাম, ঠান্ডার আমেজে সারা শরীর মন যেন জুড়িয়ে গেল।
শিলং ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে আমরা গেলাম চেরাপুঞ্জীর কিছু দর্শনীয় স্থানে।যাত্রা পথে আমাদের এবারের সঙ্গী জাকির ভাই।এ মানুষটি ও বেশ ভালো।জলখাবার খেয়ে যাত্রা করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আমরা চেরাপুঞ্জী প্রবেশ করলাম।তারপর শুরু হল একে একে না না জলপ্রপাত দর্শন।এই ঝরণা গুলির ক্ষীণকায়া দেখে মন যে খুব ভরল বলা যায় না।জাকির ভাই বললেন যে বর্ষাকালে এই সব পাহাড়ী ঝোরা জল ঝরিয়ে, জল ছড়িয়ে নেচে নেচে সশব্দে যখন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামে, সে রূপ দেখার মতো।তখন আর সেই ঝরণা শীর্ণকায়া নয়।রীতিমতো যৌবনোচ্ছল তার রূপ।সে বর্ণনায় মুখর হবেন কবি।তবে জাকির ভাই একথা ও বললেন এ সময়ের মতো গাড়ি থেকে নেমে দর্শনের সৌভাগ্য বর্ষাকালে সর্বদা হয় না, বৃষ্টির প্রাবল্যে।তবে মেঘের আলয় এই মেঘালয় বর্ষাকালে মেঘ বৃষ্টি খেলা করে অহরহ।পর্যটকরা মেঘবালিকাদের সাথে লুকোচুরি খেলার সুযোগ পায়।আমরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম।
নানা view point এর মধ্যে প্রায় সর্বত্র-ই খাসী পোশাক পরে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে।এক জায়গায় আমার কন্যা পাহাড়ী পোশাক পরে ছবি তুলল।এরপর আমরা পৌঁছলাম Mawdok view point।শীর্ণকায়া কয়েকটি পাহাড়ী ঝোরার দর্শন মিলল।এখান থেকে একটু এগিয়ে পাহাড়ী পথে একটি Eco Park রয়েছে। সেখান থেকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ দেখা যায়।পার্কটি সুন্দর করে সাজানো।বাচ্চাদের উপযোগী দোলনা, স্লিপ অনেক কিছুই সেখানে ছিল।পাহাড়ী পথে মাঝে মাঝেই দেখতে পাচ্ছিলাম খ্রীষ্টান সমাধি ক্ষেত্র।এখানে বেশ কিছু অঞ্চল খ্রিস্টান অধ্যুষিত।এরপর একে একে ওই পথে পড়ল Wah Kaba Falls, রামকৃষ্ণ মিশন, Non Kai Kai Falls ইত্যাদি।শীর্ণকায়া ঝরণাগুলি মন খুব ভরাতে না পারলেও আমাদের বেড়ানোর আনন্দে কোনো ঘাটতি ছিল না।আরো কিছু পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম Mowsmai Cave এ।দীর্ঘ দিনের বৃষ্টিপাতের জল চুইয়ে গুহার ভিতরে প্রবেশ করে, গুহার পাথরে(Lime stone) নানা ধরনের আকারআহার তৈরি হয়েছে। গুহা বেশি বড় নয়, ঢোকার রাস্তা ও বেরনোর রাস্তা পৃথক।মধ্যের বেশিরভাগ রাস্তা প্রায় বুকে হেঁটে অগ্রসর হতে হয়।অন্যান্য পর্যটকদের মুখে শুনে আমরা গুহার মধ্যে অগ্রসর না হয়ে ফিরে এলাম।খুব অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি আমাদের দুজনেরই একটু বিরূপতা আছে।যদি এই অ্যাডভেঞ্চারের দরূণ আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হয়, সে আমাদের কখনোই কাম্য নয়।সুতরাং আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে Seven sister falla বা Mawsmai falls দেখে, ফেরার পথে একটি vegetarian hotel এ মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম।
ফেরার পথে আমরা দেখলাম বিখ্যাত ELephant Falls। এই ঝরণা দেখার জন্য প্রায় দুশো (175) সিড়ি নামতে হয়।কিন্তু তারপর সত্যিই কোন আফসোস থাকেনি।সত্যিই মনে হয়েছে যে, ঝরণা কে নিয়ে মুগ্ধ গুরূদেবের বর্ণনা স্বার্থক "ঝরণা ঝরণা সুন্দরী ঝরণা, তরলিত চন্দ্রিকা চন্দন বর্ণা......."।প্রথম দেখলাম "শেষের কবিতা'র বর্ণনা সমৃদ্ধ "উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ"।কী অপরূপ যে তার উপস্থিতি ! রাস্তার দু’পাশের গাছগুলো যেন আলো করে রেখেছে রোডোডেনড্রন পুষ্পের রাশি।ফেরার পথে এক জায়গায়, গাড়ি থামিয়ে, নেমে রডোডেনড্রন ফুলে ভরা গাছের ছবি ক্যামেরা বন্দি করলাম। দিনের আলো কমে এসেছিল। কিন্তু তা ও ছবি নিলাম। এরপর অতিথি শালায় ফেরার পথে গেলাম শিলং এর বিখ্যাত ক্যাথিড্রাল চার্চ, যা শুনলাম এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম।আমরা যখন চার্চে পৌঁছলাম, তখন প্রার্থনা সঙ্গীত শুরু হতে চলেছে। অল্পক্ষণ প্রার্থনা গৃহে বসলাম। শান্ত, সমাহিত পরিবেশ মনকে ছুঁয়ে যায়। সন্ধ্যার আলোয় সাজানো মা মেরী ও যীশুর মূর্তি সত্যিই অসাধারণ।ওখানে কিছুক্ষন কাটিয়ে অতিথিশালায় ফিরে এলাম।
পরের দিন আমাদের আরো কিছু দর্শনের ইচ্ছা নিয়ে আমরা রওনা দিলাম সকালে। জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে, প্রথমে গেলাম শিলং শহরের মধ্যে অবস্থিত হয়দরি পার্ক-এ।পার্কটি র বিশেষত্ব এই যে, এখানে ছোট্ট একটি চিড়িয়াখানার দর্শন পেলাম।সেখানে নানা ধরনের পাখির সাথে সাথে বেশ কিছু পশুর দেখাও পেলাম।যেমন-মেঘলা চিতা, পাহাড়ী ভল্লুক, পাহাড়ী শকুন, বেবুন , হরিণ, পাখি ইত্যাদি।রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালো। এই পার্কের ফুলের সমাহার ও অসাধারণ। এখানে থেকে গেলাম শিলং থাকাকালীন কবিগুরুর বাসস্থানটিতে ।তখন এটি ছিল রাণী চন্দের বাসস্থান। কবিগুরু শিলং এ ওঁনার বাড়িতেই থাকতেন।বহু বছর মালিকানা বদল হয়েছে।বর্তমান মালিক অনত্র থাকেন।বাড়িটি তালা বন্ধ। প্রধান ফটকের কাছে একটি শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা রয়েছে কবির কথা।তিনি এই বাড়িতে বসে অনেক রচনায় আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হল "রক্তকরবী"।সেটির উল্লেখ রয়েছে ওই ফলকটিতে ।কবির ব্যবহৃত আসবাবপত্র রাখা আছে কাছেই অ্যাসেমব্লীর পাশে অবস্থিত রবীন্দ্র মিউজিয়ামে।সেখানে মেঘালয় সরকারের পক্ষ থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা স্বরূপ রয়েছে কবিগুরুর একটি মূর্তি।এসব-ই পর্যটকদের দেখার জন্য রাখা হয়েছে।বিধান সভার অধিবেশন চলার দরূণ মিউজিয়ামটি বন্ধ ছিল, দেখার সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারলাম না।এই আফসোস নিয়েই আমরা ওখান থেকে, অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
এবারের গন্তব্য শিলং পীক্।শিলং এর সর্বোচ্চ স্থান এটি। এখানে একটি পার্ক রয়েছে আর দুটি Watch tower, যেখান থেকে পুরো শিলং শহরটিকে ছবির মত দেখায়।এই অঞ্চলটি সেনাবাহিনীর এলাকার মধ্যে।প্রবেশ করার সময় আমাদের পরিচয় পত্র দাখিল করতে হয়েছিল।ফেরার সময় সে সব ফেরৎ পেলাম।
এরপরের গন্তব্য এশিয়ার পরিষ্কারতম গ্রাম।নাম মওলীনন্যং , পৌঁছাতে অনেকখানি সময় কেটে গেল, ওই গ্রামে প্রবেশের আগেই আমরা দেখতে গেলাম বিখ্যাত Root bridge টি।পথে শুনলাম চেরাপুঞ্জীতে অনুরূপ আরো একটি Root bridge আছে, যেটা ডবলডেকার ব্রীজ। এটিতে পৌছানোর রাস্তা বেশ দুর্গম,3700 টি সিড়ি নীচে নেমে পৌঁছতে হয়।
প্রকৃতির কি বিচিত্র এ লীলা।ছেলেবেলায় আমরা অরণ্যদেবের গাছ বাড়ির গল্প পড়ে মুগ্ধ হতাম।এখানে সত্যিকারের গাছের শিকড় দিয়ে তৈরী ব্রীজ দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম।এই ব্রীজ দেখার জন্য অনেকগুলি সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে হলো, গাছের পাতার ছায়ায় ওই রাস্তায় সূর্যের আলো ভালো প্রবেশ করে না।পরিবেশ একটু ভিজে ভিজে , স্যাঁতস্যাতে , সেই সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকার সঙ্গত যেন জায়গার মাধুর্যে আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে।এই ঝিল্লিরব শুনেই বোধহয় কবি ও লেখকের লেখনী সচল হয়েছে। নীচে কিছু দূর অবধি বাঁধানো সিড়ি থাকলেও, বাকী রাস্তা শুধু ইঁট পেতে সিড়ির আকারে দেওয়া হয়েছে। পথে বহু দেশবিদেশী পর্যটকের ভিড় দেখলাম। Root bridge এর নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে নাম না জানা একটি ক্ষীণধারা।ওখান থেকে ফিরে আমরা মওলীনন্যং গ্রামে আমাদের দ্বিপ্রহরিক আহার সম্পন্ন করলাম।এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রামে পর্যটকরাও যেন তার পরিচ্ছন্নতা বজায় না রেখে পারে না। আমরা সকলেই বেশ ক্ষুধার্ত ছিলাম। আমরা ধূমায়িত ভাত, ডাল, আলুভাজা ও পাহাড়ী মুরগির ঝোল আর স্যালাড সহযোগে খাওয়া শেষ করলাম। অপূর্ব সে রান্নার স্বাদ।এখানে দেখলাম খাবারের হোটেল গুলি সব কটি-ই মহিলাদের দ্বারাই চালিত।হোটেলের মালিক, ম্যানেজার, পরিবেশনরত কর্মী সকলেই মহিলা। এই গ্রামে অল্প কিছু বেতের পসরা সাজানো দোকান ও দেখলাম, যেগুলিতে প্রধানত পর্যটকদের -ই ভিড়।গ্রামের পরিচ্ছন্ন রাস্তার দুধারে অবস্থিত প্রতিটি বাড়িতে সুন্দর করে ফুলের বাগান করা হয়েছে।সত্যিই এর পরিচ্ছন্নতা মনকে ভরিয়ে তোলে, ভালো লাগায়।
ওখানে আরো একটু থাকার ইচ্ছা দমন করে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় Balancing Rock দেখে ওখানে থেকে আমরা রওনা দিলাম ইন্দো বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত ডাওকী গ্রামের উদ্দেশ্যে।ওই রাস্তায় বড় একটি ঝরণার দর্শনে মন প্রাণ ভরে গিয়েছিল।আমরা বর্ষাকালে মেঘের দেশে ভ্রমণে যাইনি, সুতরাং শীর্ণকায়া ঝরণার দর্শনে মন বিশেষ ভরেনি, সব চাওয়া মেটে না কখনোই।কিন্তু ডাওকী যাওয়ার পথে বোরো ফলস্ এ সে আফসোস অনেকখানি দূর হোলো। আমরা ওই জলপ্রপাতের সামনে বেশ কিছুক্ষন অতিবাহিত করলাম।ডাওকী যাওয়ার পাহাড়ী পথের ধারে ধারে সুপুরি গাছের ভিড়ের ফাঁক দিয়ে প্রতিবেশী ওপার বাংলা দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল।আমাদের ড্রাইভার জাকির ভাই-এর কাছেই শুনলাম যে ওনার আদি দেশ ওপারে-ই। বহু বছর আগে ওনার বাবা এদেশে চলে আসেন।এখনো ওনাদের কিছু আত্মীয় স্বজন ওদেশে-ই রয়ে গেছেন।এপারে ভারতের ডাওকী, ওপারে বাংলাদেশের সিলেট।ওখানে আমরা একটি নাম না জানা পাহাড়ী নদীর সেতু পার হলাম।সেতুর পাশের ফলক ব্রিটিশ যুগের সাক্ষ্য বহন করছে। এই সেতু পেরিয়ে খানিকটা গেলেই দুই দেশের চেকপোস্ট। আমরা দূর থেকে তা দেখে ফেরার পথে নাম না জানা পাহাড়ী নদীর তটভূমিতে সূর্যাস্ত দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।তটভূমিতে নুড়ি বেছানো পথে নদীর ধারে গিয়ে স্বচ্ছ জলের ধারা দেখলাম। ওখানে এক ঘন্টা করে নৌবিহারের ব্যবস্থা থাকলেও, সন্ধ্যা প্রায় আগত, তাই ইচ্ছায় লাগাম দিলাম।ওপারে আমাদের সেই চিরপরিচিত বাংলাদেশ।কত কাছের, কিন্তু কত দূর ! এই দূরত্ব মেটার নয়।নদীর ধারে খুচরো কিছু বিক্রেতা আচার, ঝালমুড়ি নিয়ে পশরা সাজিয়েছে।তাদের কথার টান শুনে বুঝতে অসুবিধা হলো না, যে তারা সকালে এদেশে ব্যাবসা করতে আসে।দিনান্তে নিজের দেশে, নিজের ঘরে ফিরে যায় নদী পেরিয়ে।ক্ষুদ্র ব্যাবসা দেশকালের গণ্ডী ছাড়িয়ে গেছে দেখে বেশ ভালো লাগলো, একটু মজা ও লাগলো।ফেরার পথে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল।সামনেই দোলপূর্ণিমা ছিল, তাই জ্যোৎস্না স্নাত পাহাড়ী পথ সম্পূর্ণ নতুন রূপে ধরা দিল দৃশ্যপটে।
কিন্তু সমতলের বাসিন্দা আমরা, ওই নিঝুম, নিস্তব্ধ, পাহাড়ী পথে রাতের অন্ধকারে বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।জাকির ভাই বোধহয়, আমাদের সেই আতঙ্কিত মনোভাব বুঝতে পেরে নানা ধরণের গল্পের মাঝে আমাদের আতঙ্ক কাটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।একসময় শহরে পৌঁছলাম।তখন সারাদিনের বেড়ানোর ফলে আমরা পরিশ্রান্ত, কিন্তু মন পরিপূর্ণ কানায় কানায়।
পরের দিন আমাদের ঘরে ফেরার পালা।কিন্তু সকালে অল্পসল্প কেনাকাটা সেরে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত ওয়ার্ডস লেক (Wards Lake) দেখতে চলে গেলাম।লেক সংলগ্ন পার্কে নানা ফুলের সমাহার ঋতুরাজের আগমন বার্তা ঘোষণা করছে। লেকের জলে নৌবিহারের ব্যবস্থা থাকলেও, সেটির সময় আরো একটু বেলায়।।আমরা ওখান থেকে ফিরে তৈরি হয়ে, গৌহাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।রাস্তায় এক জায়গায় দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।বিকেল নাগাদ গৌহাটি পৌছে গেলাম।মনকে নিজেরাই বললাম, আবার আসব ব্রক্ষ্মপুত্রের ধারের এই সুন্দর শহরে।মন একটু বিষন্ন হলেও, অনেকদিন নিজের ঘর ছেড়ে থাকার দরুন, মনে হল আমার প্রিয় শহরের আমাদের বাসাবাড়িটি যেন আমাদের আকুল ভাবে ডাকছে।বলছে, এবার তোমরা ঘরে ফিরে এসো।
সে ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা মনে মনে গেয়ে উঠলাম--"মন চলো নিজ নিকেতনে"।।
No comments