অন্যরকম উড়িষ্যা লিখেছেন Samrat Basu
কয়েকটা কম জনপ্রিয় জায়গা ঘোরার উদ্দেশে বাবা, মা, স্ত্রী ও পুত্র কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য ওড়িষার রেমুনার ইমামী জগন্নাথ মন্দির। বালাসোরের একটু আগে NH 16 থেকে ডান দিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে গিয়ে মন্দির, ইমামী পেপারমিলের সংলগ্ন কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি অপূর্ব সুন্দর এই মন্দির। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় অপরূপ সুন্দর এই মন্দির সাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে 2015 নভেম্বর মাসে। মন্দিরটি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে হলেও কোনারকের সূর্য মন্দিরের ও ছোয়া আছে। খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সুন্দর বাগান ঘেরা মন্দির চত্বরে সময় কাটাতে বেশ ভালো লাগে। সন্ধের পর আলো উদভাসিত মন্দিরের আরেক রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়।মন্দিরের কাছে কোনো থাকার হোটেল নেই, তবে আমরা ইমামীর এক কর্মীর রেকমেন্ডেশনে মন্দিরের পাশের অতিথি নিবাসে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম, খুবই সুন্দর বন্দোবস্ত সমস্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধা যুক্ত চারবেড এর ঘর।ওখান থেকে আমরা পাঁচ কিমির মধ্যে ক্ষির চোরা গোপাল ও কনকদুর্গা মন্দির দেখে এলাম। সময়ের আগে পৌঁছে যাওয়ায় গোপালের বিগ্রহ দেখার সুযোগ হয় নি, মন্দির চত্তরে ঘুরে চলে গেলাম কনকদুর্গা মন্দিরে, এখানে মাদুর্গার আঠারো হাত, বাকি সব একই রকম। ওখান থেকে ফিরে গেলাম অতিথি নিবাসে, সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল তাই আবার চলে গেলাম জগন্নাথ মন্দিরে, রাতের মন্দিরের রূপ তো আগেই বলেছি। সন্ধ্যা আরতি দেখে ফিরলাম।
পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম 54 কিমি দূরবর্তী দেভকুন্ড এর উদ্দেশে। ময়ূরভঞ্জ জেলায় এটি সিমলিপাল অভয়ারনের একটি অংশ। পাঁচ কিমি আগে চেকপোস্টে পারমিট করে এগোতে লাগলাম মেঠো উঁচু নিচু রাস্তা ধরে, দু পাশে ঘন জঙ্গল। 3.5কিমি গিয়ে গাড়ি রেখে আরও 1.5 কিমি হেঁটে যেতে হবে, পথের একধারে নদী ও অন্য ধারে পাহাড়, এই রখম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে র মধ্যদিয়ে হেঁটে যেতে বেশ ভালোই লাগছিল যতক্ষণ না একদিনের পুরান হাতির বর্জ্য চোখে পড়ল। ফোনে নেটওয়ার্ক নেই কিন্তু আগে থেকে ডাউনলোড করে রাখা গুগুল বলছে আর 400 মিটার, ঐ ভরসায় দুরুদুরু বুকে এগিয়ে চললাম।না গুগুল কাকু ভুল বলেনি পৌঁছে গেছি সুন্দর এক লেকের সামনে যার ওপরে নেমে আসছে ততোধিক সুন্দর এক ঝর্ণা। লেকের জলের ধারে নেমে ছবি তুললাম, লেকের পাস দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে যা পৌঁছে দেবে ওপরের মন্দিরে।
এবার ফেরার পালা, এতক্ষন তো হাতির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম ফেরার পথে আবার মনে পড়ায় বেশ পা চালিয়েই ফিরতে লাগলাম, তখন বেশ কয়েক জনের আর একটা দল কে উপরে উঠতে দেখে মনে বেশ বল পেলাম। ফেরার পথে ফরেস্ট চেক পোস্টে জানতে পারলাম সন্ধের দিকে প্রায়ই হাতী পাহাড় ডিঙ্গিয়ে জল খেতে আসে তাই 2 টোর পর সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। ফেরার পথে নীলগিরি প্যালেস ও কুমকূট ড্যাম ঘুরে পঞ্চলিঙ্গেস্বর এসে আজকের যাত্রার ইতি হল। রাতটা কাটিয়ে আজকের গন্তব্য কোনারক, পথে ধাবলগিরি শান্তিস্তূপ ঘুরে গেলাম।
কোনারক সূর্য মন্দিরের জন্য খুবই পরিচিত স্থান , যারাই পুরী গেছেন তারাই কোনারক গেছেন, আমিও আগে বারদুই গেছি কিন্তু এবার গেছি শুধুমাত্র 'লাইট এন্ড সাউন্ড ' শো দেখার জন্য। এক কথায় অসাধারন যা লিখে বোঝান সম্ভব নয়, আমার দেখা দিল্লির লালকেল্লায়, বা পোর্টব্লেয়ার এর সেলুলার জেলের 'লাইট এন্ড সাউন্ড ' শো গুলো কে কয়েক গুণ পিছনে ফেলে দিয়েছে এই উপস্থাপনা, কোনারকে আরও দুটি জায়গা দেখলাম interpitetion center যেটি Indian oil তৈরি করেছে ও অর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মিউজিয়াম।পরদিন সকালে কোনারক থেকে বেরিয়ে ভুবনেশ্বর এর নন্দনকানন ঘুরে গিয়ে পৌঁছলাম কটকের ধবলেস্বরে।ধবলেস্বর মহাদেবের ই আরেক রূপ, পূর্ণারথীদের ভালোই ভিড় লেগে থাকে, তবে আমাদের পূর্ণ সঞ্চয়ের ইছা নিয়ে যাই নি, গেছি ঐ জায়গায় থাকব বলে।ধবলেস্বর জায়গাটি কটক স্টেশন থেকে 17 কিমি দূরে মহানদীর বুকে একটি দ্বীপ, আকারে বলাগর এর সবুজ দ্বীপ এর থেকে একটু বড়ো। তবে ওখানে যাওয়ার জন্য একটি রোপ ব্রিজ আছে। আমরা মুলভূখণ্ডে এক জায়গায় গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে ব্রিজ পার হয়ে মন্দিরকে ডান পাশে রেখে এগিয়ে পৌঁছলাম আজকের গন্তব্য এখানকার একমাত্র থাকার জায়গা ( মন্দিরের যাত্রী নিবাস ছাড়া) হোটেল বা রিসোর্ট 'নিরুপমা ধবলেস্বর'। মধ্য বিত্তের বাজেটের মধ্যে এত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্য সাজান গোছান এই হোটেল টিতে শুধু থাকার জন্যে এখানে আসা যায়। যার প্রতিটি ঘর থেকে মহানদী কে দেখা যায়। দুপুরের খাওয়া সেরে দ্বীপে বেড়াতে বেড়ালাম, চার দিক ঘুরে পশ্চিম পারে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখে হোটেলে ফিরলাম। ততক্ষনে হোটেলের লনের শেষ প্রান্তে যেখান থেকে সিঁড়ি মহানদীতে নেমে গেছে ওখানে আমাদের জন্য চেয়ার টেবিল পাতা হয়ে গেছে, আমাদের বসতে বলা হলো। বসার পরেই কফি ও পকোরা চলে এলো, নদীর পাড়ে এ রকম রাজকীয় ভাবে বসে কফি পকোরা খাওয়ার অনুভূতি লিখে বোঝান যাবে না।
নদীর ধারে অনেক্ষন বসে থাকার পর হটাৎ একটু পূর্ণ সঞ্চয়ের ইচ্ছা জাগল, ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে এগিয়ে গেলাম মন্দিরের দিকে প্রায় 7 টা বাজে তাই পূর্ণাথীর সংখ্যা খুবই কম, মন্দির সংলগ্ল প্রায় সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, ভালোই হলো ফাঁকায় ফাঁকায় ঘুরে দেখলাম, মূল মন্দিরের গর্ভ গৃহে কোনো বিগ্রহ চোখে পড়ল না একটি গাছ কে পুজো করা হচ্ছে, আর উপরে একটি শিবঠাকুরের LED বোর্ড লাগান আছে।
যাই হোক ফিরে এলাম হোটেলে, 9টার সময় ডিনারের ডাক পড়ল, খুবই সুসাদু নিরামিষ নৈশ ভোজ সেরে ঘরে ফিরলাম।
পরদিন সকালে উঠে একটু ঘুরে ফিরে প্রাতরাশ সেরে ফেরার পথ ধরলাম, হোটেলের দুজন কর্মী ব্রিজ পার করে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে গেল।
হাতে একদিন সময় আছে তাই ঠিক করলাম এই গ্রূপে পড়েছি মন্দারমনির কাছে বিবেকানন্দ আশ্রমের কথা, বিধু মহারাজকে ফোন করতেই খুব আন্তরিক আহ্বান চলে আসুন।
জলেস্বর থেকে NH16 ছেড়ে চন্দনেস্বর-দিঘার পথ ধরলাম।আশ্রমে পৌঁছেই ব্যাগ রেখেই বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রের উদ্দেশে, রাস্তা পারহয়ে দুপাশে টমেটো ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে পথ গিয়ে পড়েছে বিচে, পরিষ্কার পরিছন্ন লম্বা সী বিচ তাতে অসংখ্য লাল লাল ফুল ফুটে আছে। একটু এগোতেই ভুল ভাঙলো যখন দেখলাম আমার ছেলের সমুদ্রের দিকে দৌড়ানোর সাথে সাথে ফুলগুলো মিলিয়ে যেতেই। ওগুলো লাল কাঁকড়া, মানুষের আনাগোনা কম বলে পরম নিশ্চিন্তে রোদ পোহাছিল আমরা যেতেই নীরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে গেল।সমুদ্রে ভাঁটা বলে জল অনেক টা দূরে, কিছুক্ষন জলে দাপাদাপি করে ফিরেগেলাম শুধু জামা কাপড় বদলানোর জন্য। ফিরে এবার সমুদ্রের ধার বরাবর হেঁটে চলে গেলাম পিছাবনী নদীর মোহনা পর্যন্ত। পুরো জায়গাটাই টমাটো চাষ হয় , সমুদ্রের ধারেই টমাটো তুলে এনে প্যাকিং করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে, ওনাদের সাথে অল্প আলাপচারিতা সেরে আশ্রমে ফেরার পথ ধরলাম।আশ্রমের ব্যাপারে গ্রূপ সবই জানান আছে নতুন কিছু বলার নেই, আমাদের উপরি পাওনা সরস্বতী পুজোটা ওখানে কাটান।
পূজারদিন মহারাজের আতিথেয়তায় দুপুরে মিশনের ছাত্র ছাত্রী দের সাথে খিচুড়ি ভোগ খেয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।
No comments