ভাইজ্যাক বলতেই ভেসে ওঠে পাহাড়, সাগর আর নারকেল গাছের সমন্বয়। ব্রিটিশ আমলের ওয়ালটেয়ারই আজকের ভাইজ্যাক। সন্ধ্যা ৭টার সাঁতরাগাছি চেন্নাই সুপার ফাস্ট ট্রেন ধরে রওনা দিয়ে, পরদিন যথাসময়ে ভাইজ্যাকে নেমে একটা ওলা নিয়ে পৌঁছে যাই হোটেলে। একটা লক্ষ্যনীয় বিষয় এখানকার বাড়িগুলোর সিঁড়ি বাড়ির বাইরে দিয়ে।
প্রথম দিনে আমাদের দেখার ছিল ইন্দিরা গান্ধী জুওলজিকাল গার্ডেন, রুশিকোন্ডা বিচ ও কৈলাশগিরি। চটজলদি ফ্রেশ হয়ে একটা ওলা নিয়ে পৌঁছে গেলাম ইন্দিরা গান্ধী জুওলজিকাল গার্ডেন। কাউন্টার সংলগ্ন বাউন্ডারিটা খুব সুন্দর সাজানো। ভিতর থেকে একটা টোটো নিয়ে পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখা হল। ৬২৫ একর এলাকায় নয় নয় করে অনেক প্রাণী সংরক্ষিত আছে যেমন হরিন, হাতি,বাঘ, শিম্পাঞ্জি, জিরাফ , ময়ূর,বাইসন,কচ্ছপ। এদিকে আকাশেও কালো মেঘ জড়ো হচ্ছিল। আশ্চর্যের বিষয় সাপগুলো কোনো কাঁচে ঘেরা নেই, একেবারে গাছে খোলা অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এরপর অটো নিয়ে পৌঁছে গেলাম রুশিকোন্ডা বিচ। ভাইজ্যাকের বিচ গুলোর মধ্যে পূর্বঘাট পর্বতের খাঁজে অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে অবস্থিত রুশিকোন্ডা হল সবচেয়ে আকর্ষণীয়,যেমন তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তেমনি তার পরিচ্ছন্নতা। দিগন্ত প্রসারিত শান্ত সমুদ্র,স্বচ্ছ কাঁচের মত জল,একদিকে সবুজে মোড়া পাহাড় ও টিলার সহাবস্থান প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে রুশিকোন্ডা এককথায় অসাধারণ । স্নানোপযুক্ত হওয়ায় এবং মনোরম হলুদ বালির এই বিচ বিদেশী পর্যটকদের খুব প্রিয়(বাথরুমের ব্যবস্থা রয়েছে)। নানারকম ওয়াটার স্পোর্টসও রয়েছে। সূর্যাস্তের পর একটা ডাব নিয়ে শুধুমাত্র সমুদ্র ও তার হালকা ঢেউ দেখতে দেখতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। এরপর অটো নিয়ে রওনা দিলাম কৈলাস গিরি।
অটো থেকে নেমে দেখলাম প্রায় ৫/৬ তলা বাড়ির সমান সিঁড়ি উঠে রোপওয়ে কাউন্টার। তাই ঐ সিঁড়ি না ভেঙে একটা অটো নিয়ে হিলটপে পৌঁছে যাই। কথা হলো ১ ঘন্টা অপেক্ষা করে তারপর নামিয়ে আনবে। সমুদ্র তল থেকে ৫৬৮ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই স্থানটি আসলে একটা পার্ক। পুরো বিশাখাপত্তনম শহরটা পাখির চোখে ধরা পড়ে। সমগ্র এলাকা পায়ে হাঁটার বদলে চড়ে বসলাম ট্রয় ট্রেনে। ঝকঝকে তকতকে পরিস্কার ট্রেনটির লাইন পাতা গোলাকারে। তাই পুরো শহরটার সাথে সাথে পার্কের ও ভ্রমণ হয়ে গেলো। পার্কের মধ্যে শিব পার্বতির বিশাল মূর্তি রয়েছে। এর পর সোজা ফিরলাম হোটেলে। সন্ধেবেলা শ্রী সাই রাম পার্লার নামের স্থানীয় রেস্টুরেন্টে লোকাল খাবার খেয়ে দেখার মতন।
পরদিন সকালে একটা ওলা নিয়ে পৌঁছে গেলাম শিমাচলম পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত শিমাচলম মন্দির। মন্দিরে ব্যাগ, মোবাইল নিষিদ্ধ। অন্যান্য মন্দিরের মত এখানেও টিকিটের ব্যবস্থা আছে। দক্ষিণ ভারতের শিল্পরীতিতে নির্মিত এয়োদশ শতকের এই মন্দির (পুরান মতে ) ভক্ত প্রহ্লাদ নির্মিত, মূলত বিষ্ণু পূজিত হন বরাহ নৃসিংহ রূপে। বিষ্ণুর সারা দেহ চন্দনে আবৃত থাকে সারা বছর, শুধু মাত্র অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ১২ ঘন্টার জন্য আসল রূপ দেখা যায়। পুরানে বিষ্ণু কিভাবে নরসিংহের রূপ ধারণ করে হিরন্যকশ্যপকে বধ করেছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে দেওয়ালের কারুকার্যে। আমরা জন প্রতি ১০০ টাকার টিকিট কেটে একেবারে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করলাম। বিগ্রহকে আরও সামনে থেকে দেখার জন্য ৫০০টাকা অতিরিক্ত । বাইরে থেকে প্রসাদ খেয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম।
এবার রওনা হলাম ইয়ারাডা বিচের উদ্দেশ্যে, পোর্ট রোড ধরে গাড়ি এগিয়ে চলল । পথে মধ্যে নৌ সেনার বেশ কিছু ভবন, নেভি কলোনি চোখে পড়ল। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম তীরে, শহরের কোলাহল থেকে মুক্ত ৩২কিমি দূরের এই বিচ মূলত তিন দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। তবে সমুদ্র সৈকত ও সারিবদ্ধ নারকেল গাছের সৌন্দর্য অপূর্ব। শান্ত সমুদ্রের ঢেউ আছরে পড়ছে বেলাভূমিতে। তবে এই বিচের গভীরতা অনেক বেশি এবং খুবই গড়ান, তাই জলে নামা, সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ। হাঁটতে হাঁটতে ও বেলাভূমিতে বসে বালি নিয়ে খেলতে খেলতেই চোখে পড়লো লাল কাঁকড়া, মানুষের পদধ্বনি শোনা মাত্র গর্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে । সুদৃশ্য বিচের সাথে পাল্লা দিচ্ছে দক্ষিণ ভারতের রোদ। ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরও ফিরে আসতে হলো।
এবার গন্তব্য ফিসিং হারবার। ইয়ারাডা বিচ থেকে ভাইজ্যাকের ফিসিং হারবারের দূরত্ব ছিল ২২ কিমি, ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। ঢোকবার পথেই চোখে পড়ল ফাঁকা বন্দরে বড় বড় কন্টেনার। একটু এগোতেই টের পেলাম সুটকি মাছের উগ্র গন্ধ। জানলার কাঁচ তুলে দেওয়ায় কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছিলাম। কিছু ছোটো বড়ো জাহাজ বাঁধা আছে আর কিছু জাহাজ নোঙর ফেলার তোরজোড় করছে। এখান থেকেই প্যাকেট বন্দি হয়ে ড্রাই ফিস বিদেশে রপ্তানি হয়। রাস্তার দুপাশে শুধু ছড়ানো আছে মাছ, কোনো ঢাকা পর্যন্ত নেই। তারই পাশে কাক কুকুর সবই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই এলাকায় প্রচুর দক্ষিণী সিনেমার শ্যুটিং হয়। তারপর আমাদের গাড়ি আর,কে,বিচে এসে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো।
রুশিকোন্ডা ও ইয়ারাডা বিচ দেখার পর আর,কে বিচ সেভাবে মন টানেনি। এই বিচ অনেক অপরিস্কার , বড় বেশি জনসমাগম। পুরী বিচের থেকে আলাদা কিছু মনে হয়নি। যদিও শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় খুব জনপ্রিয় এবং এই বিচকে কেন্দ্র করে প্রচুর হোটেল ও জনবসতিও গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন দামের হোটেল এই এলাকায় রয়েছে । বিচে পৌঁছানোর সাথে সাথেই টিপ টাপ বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় বেশি ক্ষন থাকা হয়নি।
ছাতার তলায় মাথা বাঁচিয়ে পৌঁছালাম বিচের ঠিক উল্টো দিকে এয়ার ক্রাফট মিউজিয়ামে। টিকিট কেটে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সকলকে ১টাকার বিনিময়ে একটি করে মোবাইল ফোন ও হেডফোন দিয়ে দিলো এবং কিভাবে তা ব্যবহার করতে হবে বলে দিলো। এই মিউজিয়ামে যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত অস্ত্র শস্ত্র ও বিভিন্ন ধরনের জিনিস সুসজ্জিত আছে ,এরোপ্লেনের টায়ার থেকে শুরু করে প্যারাশুট সবেরই বর্ননা রয়েছে। একটা যুদ্ধ বিমানও রয়েছে যার সাথে সাধারণ বিমানের বিস্তর ফারাক।
এরপর গন্তব্য নৌ বাহিনীর বিশাখা মিউজিয়াম। পুরোনো ভাইজ্যাক শহরের অনেক ইতিহাস সংরক্ষিত আছে। এক সময়ের ভগ্ন ডাচ ভবন ছিলো এটি, পরে সংস্কার করে মিউজিয়াম হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা ও যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত নৌবহরের মডেল ও তার বিবরণ, বিভিন্ন দেশের দেওয়া উপঢৌকন, বিজয়নগর ও বব্বিলি রাজাদের সাজ সরঞ্জাম, যুদ্ধাস্ত্র, গ্রিক ও ভাইকিংদের শিরোস্ত্রান,তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, পুঁথি এবং আরো অনেক কিছু সংরক্ষিত আছে ।
এরপর গেলাম আই এন এস কুরুসাওয়া, দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সাবমেরিন মিউজিয়ামে। লোহার সিঁড়ি বেয়ে ভিতরে ঢুকতেই ,এক গাইড জাহাজ সম্পর্কে দুকথা বললেন । এই জাহাজ যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৬৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বর, আর শেষ করে ২০০১ সালের ২৭শে ফ্রেবুয়ারি। দীর্ঘ ৩১ বছর সার্ভিস দেওয়ার পর জাহাজটিকে তুলে এনে জনসমক্ষে প্রদর্শন করার জন্য প্রস্তুত করা হয় । ১৯৭১ সালে ইন্দো পাকিস্তান যুদ্ধে এই জাহাজের অংশ নেয়। ২০০২ সালের অগাস্টে এটি সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় । দুদিকে ২ ফুটের কেবিন রয়েছে আর মাঝখান দিয়ে সরু প্যাসেজ । এক জন মানুষই সেখানে থাকতে পারে এই কেবিনে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম কত কষ্ট করে নৌসেনারা মাসের পর মাস কাটায় । চারিদিকে অসংখ্য মেশিন, তার মধ্যেই টেবিল চেয়ার, দূরবিন দিয়ে পর্যবেক্ষণ রুম, ডাইনিং রুম , রান্না ঘর , বাথরুম সবই রয়েছে । আমাদের ঐ জায়গায় সামান্য হলেও অক্সিজেনের অভাব বোধ হচ্ছিল , তাহলে ভেবে দেখুন যারা থাকে তারা কতটা কষ্ট করে থাকে।
No comments