হায়দ্রাবাদ শুধু মুক্ত নগরী, বা তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র হিসাবে নয় , হায়দ্রাবাদের একটা প্রাচীন ইতিহাস আছে । আর হায়দ্রাবাদের দর্শনীয় স্থান গুলোর সাথে সে ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত । তাই আমার লেখাতে ভ্রমণের সাথে সাথে ইতিহাসকেও তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি যাতে শহরটাকে সব দিক থেকেই জানা যায় ।
মুসি নদীর তিরে তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দ্রাবাদের পত্তন ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে গোলকন্ডার পঞ্চম নৃপতি কুতুব শাহের হাত ধরে । এর শহরের নামকরনেরও একটা গল্প আছে । কুতুব শাহের হিন্দু প্রেমিকার ( ভাগমতী) নামে নামকরণ হয় ভাগ্যনগরী । পরে তিনি নবাবের বেগম হলে তার নাম পরিবর্তন হয় হায়দর মহল । তা থেকেই এই শহরের নতুন নাম হয় হায়দ্রাবাদ । হায়দ্রাবাদের যমজ শহর সেকেন্দ্রাবাদ হুসেন সাগর দ্বারা বিচ্ছিন্ন । শিল্প ও কম্পিউটার মিলে আজ হায়দ্রাবাদের উন্নয়ন সারা ভারতে সারা ফেলেছে । উর্দু ভাষী মুসলিম ও ইসলামী সংস্কৃতির হায়দ্রাবাদ রাতে আলোকিত হয়ে ওঠে। শহরের মোগলাই খাবারের সাথে বাদশাহী আদব কায়দা পর্যটকদের তৃপ্ত করে । তেমনি রামকৃষ্ণ মিশনের দূর্গাপূজা ও সেকেন্দ্রাবাদের বাঙালি সমিতি , ইসকনের মন্দির যেন দুই ধর্মের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে ।
২০১৭ ডিসেম্বরে, ৫ দিনের জন্য অফিস ট্যুরের গন্তব্য ছিল এটাই । অবশ্যই হাতে সময় কম, তাই বিমান ছাড়া গতি নেই । যদিও কলকাতা থেকে ডিরেক্ট ফ্লাইট না পাওয়ায় রায়পুরে গিয়ে ঘন্টা দুয়েক বিরতি নিয়ে আবার হায়দ্রাবাদ গামি ফ্লাইটে চড়া । সন্ধ্যা ৭ টায় পৌঁছালাম রাজিব গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে । বাইরেই অপেক্ষা করছিল অফিসের বাস । আধা ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম হোটেল সিয়েস্তা হাইটেক (হাইটেক সিটি, হায়দ্রাবাদ)। দ্বি-শয্যার বিলাস বহুল রুমে পৌঁছে শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে সারা দিনের ধকল কিছুটা হলেও মিটলো । হোটেলে আসার পথেই চোখে পড়ল সবজান্তা গুগল এর অফিস ও আরও অনেক আকাশচুম্বী বিজনেস টাওয়ার ।
পরদিন সকাল সকাল তৈরী হয়ে রওনা দিলাম মূল শহর থেকে ১১ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত গোলকোন্ডা ফোর্টের উদ্দেশ্যে । মিনিট ২০'র মধ্যেই হাইওয়ে ছেড়ে পৌঁছে গেলাম সরু ঘিঞ্জি রাস্তায়, অবশেষে ঢুকে পড়লাম ফোর্টে । তার মধ্যে আমাদের বড় বড় দুটো বাস ঢুকে আরও জ্যাম বাঁধিয়ে দিয়েছে । ভিতরে প্রবেশ করে দূর্গের সামনে বাগানটায় দাঁড়িয়ে উপলদ্ধি করছিলাম ইতিহাসকে । কত ঘটনার সাক্ষী এই দূর্গ । গ্রানাইট নির্মিত গোলকোন্ডা শহর ও দূর্গটি (৩২০ফুট উঁচু) প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে ১১৪৩ সালে কাকতীয়দের দ্বারা নির্মিত হলেও পরে রানী রুদ্রমা ও তার উত্তরসূরি দের হাতে পূননির্মিত হয় । এরপর বাহমনি ও কুতুব শাহী বংশ পরপর রাজত্ব করে । গোলকোন্ডা দাক্ষিণাত্যের রাজধানী ছিল ১৫৯১ সাল পর্যন্ত, তারপরে হায়দ্রাবাদে স্থানান্তরিত হয় । এখানে উল্লেখ্য কুতুব শাহী আমলেই দূর্গটি ৫ কিমি বিস্তৃত হয় , পরবর্তী ৬২ বছরে আরও ৭ কিমি বিস্তৃত হয়। সেকালে দূর্গের চারপাশে পরিখা ছিল । ৩৬০ ধাপ সিঁড়ি উঠে পাহাড় চূড়ায় খিলান যুক্ত ত্রিতল তানা শাহী কি গদি বা দরবার হল । সিঁড়ি পথের ডানদিকে ঝরনায় সুশোভিত পাতকুয়া ছিল । ১৬৮৭ সালে ঔরঙ্গজেব কর্তৃক আটমাসের অবরোধে দূর্গটি ভেঙ্গে যায় । একজন গাইড নেওয়া হলো যাতে দেখার সাথে সাথে ইতিহাসকে জানাও যায় । ১০কিমি বিস্তৃত অর্ধচন্দ্রাকৃতি গোলকোন্ডা দূর্গটি অভ্যন্তরে ৪ টি স্বতন্ত্র দূর্গ, ৮টি প্রবেশপথ, ৪ টি টানাসেতু, বেশকিছু রাজকীয় ভবন, হল, মন্দির, মসজিদ, অস্ত্রাগার, আস্তাবল নিয়ে গঠিত । সবচেয়ে নিচে বাইরের দিকে আছে ফতেয় দরওয়াজা, এখান দিয়েই ঔরঙ্গজেবের বিজয়ী সেনা দূর্গে প্রবেশ করেছিল । এই দরজাই বড় বড় লোহার খিলান দিয়ে তৈরী করা যাতে হাতি ও সৈন্য আক্রমণ প্রতিহত করা যায় । দরজা পেরোতেই একটা গম্বুজ, এর নির্দিষ্ট স্থানে হাততালি দিলে তা ১কিমি দূরে অবস্থিত বালা হিশার প্যাভেলিয়ানে শোনা যেত । গম্বুজ পেরিয়ে বাঁদিক দিয়ে সোজা গেলেই সুন্দর বাগান ,যা ৪০০ বছরের অতীত গৌরবের কথা স্মরন করিয়ে দেবে । কথিত আছে দরবার থেকে পাহাড়ের পাদদেশ অবধি একটা সুড়ঙ্গ পথ ছিল । দূর্গের ওপর দিকে কুতুব শাহী সুলতানদের ইসলামিক রীতিতে গঠিত সমাধী, কালা মন্দির, দরবার ছিল ।আর দূর্গের ভিতর দিকে মনিমুক্ত খচিত নানান প্রাসাদ, হারেম মহল, মন্দির,তামার ফোয়ারায় গোলাপ জলের তার্কিশ বাথ, ত্রিতল তোপখানা, অন্ধকার কারাগার, হাবসি কামান, আশলা খানা, তারামাটি মসজিদ, রামদাস বন্দিখানা, উটের আস্তাবল, অম্বরখানা, দরবার হল, নাগিনা বাগ, রামসসা কোঠা ইত্যাদি । তবে স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন সবই ধংসের মুখে । সেভাবে রক্ষনাবেক্ষণও চোখে পড়লো না । তবে যত উপরে উঠেছি সিঁড়ি ক্রমশ চড়াই এবং কিছু কিছু জায়গায় সিঁড়ির কোনো অস্তিত্ব নেই । তবে যে কথা বলতেই হয় গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে রক্ষা পাবার জন্য জটিল ভাবে দূর্গের নকশা বানানো এবং সমস্ত দূর্গ জুড়ে সেই সময়েই জল সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল । মাটির নল ও পার্সিয়ান চাকার সাহায্যে ছাদের ওপর জল তুলে ঠান্ডা রাখা হতো প্রাসাদ । গোলকুন্ডার হীরের জগৎ জোড়া নাম ছিল অতীতে । কৃষ্ণা অববাহিকায় পাওয়া যেত হীরে , আরব, পারস্য, তুরস্ক থেকে ব্যবসায়ীরা আসত । এমনকি ব্রিটিশ মুকুটে কোহিনুর হীরেটিও এই গোলকোন্ডার নাম উজ্জ্বল করে । এখানে রাতে লেজার শো'র ব্যবস্থা আছে । অমিতাভ বচ্চনের কন্ঠে ১ ঘন্টার গোলকোন্ডার ইতিহাস শোনা যায় ধারাভাষ্যে ।
এরপর গন্তব্য কুতুব শাহী সমাধী ক্ষেত্র । কুতুব শাহী সমাধী স্থল গোলকোন্ডা ফোর্ট থেকে অনতিদূরে ইব্রাহিম বাগে অবস্থিত । শাহী সুলতানদের সমাধী শায়িত থাকলেও শাহী রাজত্বের পরবর্তী কালে যথেষ্ঠ উপেক্ষিত হয়েছিল, তবে ৩য় শতকে সালার জং সাহেবের তৎপরতায় আবার তা পূননির্মিত হয় । এখানে মূলত দুধরনের সমাধী চোখে পড়ে । ছোট সমাধী গুলির গ্যালারীতে একক মন্দিরে থাকে এবং বড়গুলি দুটি তলা ও মন্দির বা চূড়া । কথিত আছে ঔরঙ্গজেব এখানে নামাজ পড়তেন । সম্প্রতি খনন কার্যের ফলে কুতুব শাহী সুলতানদের গ্রীষ্মাবাসও আবিষ্কৃত হয়েছে ইব্রাহিম বাগের মাটির নিচে । তবে নিরিবিলি শান্ত এই পরিবেশে বেশ কিছুটা সময় একাকি কাটানো যায় ।
এরপর অল্প সময়ের জন্য ঘুরে আসতেই পারেন শিল্পরমম থেকে । হাইটেক সিটি থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত ৩০ একর জমির ওপর শিল্প ও সংস্কৃতির অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছে এক ছাদের তলায় । ঝর্না ও ঘাসের জাজিমে (গদি বিশেষ) পাথর খোদাই করে তৈরি হয়েছে নানা শিল্প সম্ভার । সারা ভারত থেকে আগত শিল্পীদের সৃষ্ট শিল্প দেখা ও কেনার ব্যবস্থা আছে । বিভিন্ন ধরনের মূর্তি (মাটি ও পাথরের) , হায়দ্রাবাদের ঐতিহ্য ( শাড়ি , গহনা) সবই সহজলভ্য এখানে ।
হায়দ্রাবাদের অপর আকর্ষণীয় স্থান হায়দ্রাবাদ - বিজয়ওয়ারা হাইওয়ের হায়াৎনগরের রামোজি ফিল্ম সিটি । হাইটেক সিটি থেকে পৌঁছাতে সময় লাগল ১.৩০ ঘন্টা (প্রায় ৬৭ কিমি ) । হায়দ্রাবাদ শহর থেকে ও অন্ধ্রের নানান শহর থেকে বাস আসছে একেবারে ফিল্ম সিটির প্রবেশ দ্বারে । ভিতরে ঢোকার পর অনেক ক্ষন অপেক্ষা করতে হয়েছিলো , একে তো ডিসেম্বরের প্রচন্ড ভিড় ,তায় আমাদের দুটো বাসে অফিস কলিগ ও তাদের ফ্যামিলি মিলিয়ে ১২০ জন । বিভিন্ন মূল্যের টিকিট পাওয়া যায় , তাতে বিভিন্ন প্যাকেজ । আমাদের ২৫০০/ পার পারশন লেগেছিল ।
রামোজি ফিল্ম সিটি সম্পর্কে যে কথা না বললেই নয় , ১৯৯১ সালে রামজি গ্রুপের প্রধান রামজি রাও কর্তৃক স্থাপিত ফিল্ম সিটি 2500 একরেরও বেশি বিস্তৃত এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম স্টুডিও কমপ্লেক্স হিসাবে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তুলেছে । এখানে একত্রে 20 টি চলচ্চিত্র ইউনিট কাজ করতে পারে । যাই হোক সেখানেই আধ ঘন্টার মত অপেক্ষা করার পর সকলেই হাতে একটা করে ব্যাচ পেলাম , সেগুলো জামার ওপর বুকে সেঁটে দিতে হলো ।
তারপর আবার নিজেদের বাসে উঠে আরও কিছু দূর গিয়ে ছেড়ে দিতে হলো বাস । এরপর বাকি যাত্রা সম্পন্ন হলো রামোজির নিজস্ব ভিনটেজ বাসে । দীর্ঘ লাইন অতিক্রম করে উঠে পড়লাম লাল রঙের ভিনটেজ বাসে । প্রতি বাসে একজন করে গাইড রয়েছে । ডাইনে বায়ে নানা রঙের অনেক বিল্ডিং চোখে পড়ল , সব কটারই ইতিবৃত্ত শোনালেন গাইড, কোনোটায় সূর্যবংশম এর শুটিং হয়েছে তো কোনোটায় রকস্টার, তো কোনোটায় আশিকি ২, জেলখানার শুটিং, এয়ারপোর্ট ও প্লেনের ডামি সেট , চেন্নাই এক্সপ্রেস খ্যাত বিজয়ওয়ারা স্টেশন যার একদিকে গ্রামের দৃশ্য অপর দিকে শহরের সেট , ইউরেকা জং, বিল্ডিং স্ট্রাকচার, গ্রামের ডামি সেট, মহাভারতের সেট, কৃপালু গুহা , হাওয়া মহল ( এখানে টি ব্রেকের ও ব্যবস্থা আছে), জাপানি গার্ডেন, হলিউড সাইনেজ, লন্ডন স্ট্রিট, ল্যাবরেটরিজ, হাসপাতাল, ল্যান্ডস্কেপ, বাটারফ্লাই পার্ক, উইং বার্ড সেঞ্চুচুয়ারি ( এখানে মডেল পাখি ও শো পিসের দোকান ও আছে ), ভমন বনসাই বাগান , সান ফাউন্টেন ডামি সেট, মুভি ম্যাজিক । এছাড়াও অনেক রকম শো হয় তার জন্য আলাদা প্রবেশ মূল্য । যেমন লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন ( হলিউড ব্যাকলাইট স্পেকটাকুলার), অ্যাকশন থিয়েটার ( লাইভ মুভি ক্রিয়েশন) , ডান্স শো ( স্পিরিট অফ রামোজি) , ফোর্ট ফ্রন্টটেয়ার ( ওয়াইল্ড ওয়েস্ট স্টান শো) । তবে একটাই অসুবিধা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা যেতে হলে হাঁটার কোনো অপশন নেই, ওই রামোজির বাসে আপনাকে উঠতেই হবে, সব সময় যে ভিনটেজ বাস আসছে তা নয়, ওটা প্রথমবার ছিল, তার পরের গুলো এমনি বাস, এমনকি স্কুল বাস ও ছিল । পিক সিসন হওয়ায় ভিড়ও প্রচন্ড , তাই বেশ গুতোগুতি করেই বাসে উঠতে হয়েছে এমনকি এক জায়গায় তো রিতিমত মারামারি করে । এই এক জায়গায় বড্ড অবহেলা অনুভব করেছি । এত এত টাকা দিয়ে টিকিট কাটার পর বাস ধরার জন্য এই পদ্ধতি আশাতীত । রামোজির তরফ থেকে যদি একটু সুবন্দোবস্ত করতো তাতে দর্শকদেরও সুবিধা হয় ।
একদিনে রামোজির সব কিছু দেখা সম্ভব নয় , ১ রাত থেকে দেখারও ব্যবস্থা আছে । সেরকম প্যাকেজ ও বাছাই করতে পারেন । সিতারা , সাহারা , বসুন্ধরা, তারা নামের তারকা হোটেল রয়েছে এছাড়াও প্রচুর রেস্টুরেন্ট আছে । সারাদিন ধরে হেঁটে হেঁটে পা গুলো একটু বিশ্রাম চায় । এরপর হোটেলে ফেরার পালা ।
পরদিন আমাদের গন্তব্য ছিল হুসেন সাগর লেক । হায়দ্রাবাদ ও সেকেন্দ্রাবাদের সংযোগকারী বাঁধ গড়তে হুসেন সাগরের সংস্কার । কথিত আছে , ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভের ফলে হুসেন শাহ ওয়ালির প্রতি কৃতজ্ঞতা বশত ১৫৬২ সালে ইব্রাহিম কুলী কুতুব শাহ লেক খনন করেন । সকাল ও সান্ধ্য ভ্রমণের জন্য এটি আদর্শ স্থান । বিভিন্ন রকমের বোটিং করে লেক ভ্রমনের ব্যবস্থা আছে । লেকের মাঝে স্ট্যাচু টি দারুন । তবে এই সাগরের জল ভয়ঙ্কর নোংরা । নানা ভাবে দূষিত এবং আমরা নিজেরা দেখেছি ক্রেন দিয়ে নোংরা , প্লাস্টিক তোলা হচ্ছে । পাশেই আছে লুম্বিনী পার্ক , মূলত এটি প্রাত ভ্রমণ ও সান্ধ্য ভ্রমণের জন্য আদর্শ । তবে সন্ধ্যায় লেজার শো হয়।
এবার আমাদের বাস এগিয়ে চলল মুসি নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত সালার জং মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে । যেতে যেতেই চোখে পড়ল নর্দমায় ও আস্তাকুঁড়ে পরিনত হওয়া মুসি নদী । নিজামের প্রধানমন্ত্রী মীর ইউসুফ আলী খান ( ৩য় সালার জং) ১৯১৪ সালে চাকরি ছেড়ে নিজের সংগ্রহ বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন । তার মৃত্যুর পর ১৯৫১ সালে জহরলাল নেহরু জালার জং প্যালেসে মিউজিয়াম গড়ে তোলে জাতীয় স্বার্থে । তবে পরবর্তী কালে বর্তমানের নতুন ভবনে মিউজিয়াম স্থানান্তরিত হয় , একক সংগ্রহে বিশ্বের অন্যতম মিউজিয়াম এটি । মূলত মেইন, ওয়েস্টার্ন, ইস্টার্ন এই ৩ টি জোনে ৩৫ টি রুমে ৩৫০০০ সম্ভার সুসজ্জিত আছে । তবে কথিত আছে অনেক জিনিসই জায়গার অভাবে বাক্সবন্দী হয়ে আছে আজও । সামান্য কিছু টাকায় টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম ভিতরে , তবে সঙ্গে কোনো জিনিস নিয়ে যাওয়া যায়না , (মানিব্যাগ ছাড়া) । এখানে বলে রাখি বিনা পয়সায় গাইড ও মেলে আধা ঘন্টার জন্য , কিন্তু ওই পিক সিজনে তাদের দেখা মেলা দুষ্কর । অগত্যা নিজেরাই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, সবেরই বর্ননা রয়েছে , একটু সময় লাগবে এই আর কি ।
চীন , জাপান, বর্মার পৃথক হল আছে , তাছাড়াও জুয়েল হল, পেয়েন্টিং হল, স্কাল্পচার হল, ম্যানুস্ক্রিপ্ট হল আছে । নূরজাহানের ড্যাগার, টিপুর হাতির দাঁতের চেয়ার, ঔরঙ্গজেবের তরোয়াল, জাহাঙ্গীরের মদ্যপানের কাপ দেখার মত , যেন মনে ইতিহাস কথা বলছে । এছাড়াও আছে ব্রোঞ্জ ও টেক্সটাইলের রুম, পাথরের মূর্তির রুম, দক্ষিণ ভারতীয় শিল্প সম্ভার, বয়ন শিল্প, বিভিন্ন ধরনের ঘড়ি, বিদেশী পুতুল(R7), হাতির দাঁতের রকমারি শিল্প, বিভিন্ন সুলতানদের তরোবারি , বন্দুক ও নানান অস্ত্রসস্ত্র , ধাতব সম্ভার, ছবির সংগ্রহ শালা , পুতুল ও খেলনার সম্ভার( R16), মর্ডান আর্টের সম্ভার ( অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি স্থান পেয়েছে), ধর্মীয় শিল্পকলার সম্ভার, কাশ্মীরের কার্পেট ও আসবাবপত্রের সম্ভার, ফরাসী ও ইউরোপীয় শিল্প কলা, পোর্সেলিনের বাসনপত্র নিয়ে এক বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ শালা । এছাড়াও রেবেকার অবগুন্ঠিতা সুন্দরী নারী মূর্তি ( যেটা ৭লক্ষ টাকা দিয়ে রোম থেকে আনা হয় ১৮৭৬সালে), একই কাঠের গুঁড়িতে একদিকে নারী ও অপর দিকে পুরুষ মূর্তিটিও নজর কাড়ে । যেকথা বলতেই হবে এই বিশাল বড় মিউজিয়াম দেখতে একটা গোটা দিন লাগবেই ।কাজেই সেই ভাবে সময় নিয়ে যাবেন ।
এখান থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল , এবার আমরা অফিসের বাস ছেড়ে দিয়ে নিজেরা স্বামী স্ত্রী ও ছানা বেরিয়ে পড়লাম একটা অটো নিয়ে চারমিনারের উদ্দেশ্যে । মিনিট ৫ এর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পুরোনো হায়দ্রাবাদের প্রাণকেন্দ্র চারমিনারে । শহর থেকে প্লেগ মহামারী দূর করে স্মারক রূপে মহম্মদ কুলী কুতুব শাহ ১৫৯৩ সালে সম্পন্ন করেন চুন ও পাথরের তাজিয়া ঢঙে কারুকার্যময় হলুদ রঙের এই চারমিনারটি । কথিত আছে এই স্থানেই নাকি নবাব ভাগমতীকে দর্শন করেন । চারটি সরু মিনার চারপাশে , চারদিকে চারটি গেট এবং ১৪৯ ধাপের স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে মিনারের ওপরে ওঠা যায় । দোতলায় মন্দির, তিনতলায় মসজিদ, এখানে নবাব পরিবারের শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল একসময় । রাতে আলোক মালায় সেজে ওঠে যদিও তা দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের । এই চারমিনার চত্বরটাকে কলকাতার ধর্মতলার সাথে তুলনা করলে খুব একটা ভুল হবে না । চারিদিকে জিনিস পত্রের সম্ভার নিয়ে বেচাকেনা চলছে , এটা হায়দ্রাবাদের পুরোনো লাড বাজার, এখানে খরিদ্দারও লোকাল । কি নেই এখানে, বালা চুড়ি, কঙ্কন, বিদরি শিল্পের নানান জিনিস, সোনা রুপার ঝালরের কারুকার্যময় পোশাক, ব্রোকেড শাড়ি, শেরওয়ানি দুপাট্টা , রকমারি লুঙ্গি, কলমকারি বেডকভার, হুকা রেকাবি বাক্স ,অ্যান্টিক জিনিস সব আছে , তবে জিনিস বুঝে তার দাম ও আছে ।
মুসি নদীর তিরে তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দ্রাবাদের পত্তন ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে গোলকন্ডার পঞ্চম নৃপতি কুতুব শাহের হাত ধরে । এর শহরের নামকরনেরও একটা গল্প আছে । কুতুব শাহের হিন্দু প্রেমিকার ( ভাগমতী) নামে নামকরণ হয় ভাগ্যনগরী । পরে তিনি নবাবের বেগম হলে তার নাম পরিবর্তন হয় হায়দর মহল । তা থেকেই এই শহরের নতুন নাম হয় হায়দ্রাবাদ । হায়দ্রাবাদের যমজ শহর সেকেন্দ্রাবাদ হুসেন সাগর দ্বারা বিচ্ছিন্ন । শিল্প ও কম্পিউটার মিলে আজ হায়দ্রাবাদের উন্নয়ন সারা ভারতে সারা ফেলেছে । উর্দু ভাষী মুসলিম ও ইসলামী সংস্কৃতির হায়দ্রাবাদ রাতে আলোকিত হয়ে ওঠে। শহরের মোগলাই খাবারের সাথে বাদশাহী আদব কায়দা পর্যটকদের তৃপ্ত করে । তেমনি রামকৃষ্ণ মিশনের দূর্গাপূজা ও সেকেন্দ্রাবাদের বাঙালি সমিতি , ইসকনের মন্দির যেন দুই ধর্মের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে ।
২০১৭ ডিসেম্বরে, ৫ দিনের জন্য অফিস ট্যুরের গন্তব্য ছিল এটাই । অবশ্যই হাতে সময় কম, তাই বিমান ছাড়া গতি নেই । যদিও কলকাতা থেকে ডিরেক্ট ফ্লাইট না পাওয়ায় রায়পুরে গিয়ে ঘন্টা দুয়েক বিরতি নিয়ে আবার হায়দ্রাবাদ গামি ফ্লাইটে চড়া । সন্ধ্যা ৭ টায় পৌঁছালাম রাজিব গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে । বাইরেই অপেক্ষা করছিল অফিসের বাস । আধা ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম হোটেল সিয়েস্তা হাইটেক (হাইটেক সিটি, হায়দ্রাবাদ)। দ্বি-শয্যার বিলাস বহুল রুমে পৌঁছে শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে সারা দিনের ধকল কিছুটা হলেও মিটলো । হোটেলে আসার পথেই চোখে পড়ল সবজান্তা গুগল এর অফিস ও আরও অনেক আকাশচুম্বী বিজনেস টাওয়ার ।
পরদিন সকাল সকাল তৈরী হয়ে রওনা দিলাম মূল শহর থেকে ১১ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত গোলকোন্ডা ফোর্টের উদ্দেশ্যে । মিনিট ২০'র মধ্যেই হাইওয়ে ছেড়ে পৌঁছে গেলাম সরু ঘিঞ্জি রাস্তায়, অবশেষে ঢুকে পড়লাম ফোর্টে । তার মধ্যে আমাদের বড় বড় দুটো বাস ঢুকে আরও জ্যাম বাঁধিয়ে দিয়েছে । ভিতরে প্রবেশ করে দূর্গের সামনে বাগানটায় দাঁড়িয়ে উপলদ্ধি করছিলাম ইতিহাসকে । কত ঘটনার সাক্ষী এই দূর্গ । গ্রানাইট নির্মিত গোলকোন্ডা শহর ও দূর্গটি (৩২০ফুট উঁচু) প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে ১১৪৩ সালে কাকতীয়দের দ্বারা নির্মিত হলেও পরে রানী রুদ্রমা ও তার উত্তরসূরি দের হাতে পূননির্মিত হয় । এরপর বাহমনি ও কুতুব শাহী বংশ পরপর রাজত্ব করে । গোলকোন্ডা দাক্ষিণাত্যের রাজধানী ছিল ১৫৯১ সাল পর্যন্ত, তারপরে হায়দ্রাবাদে স্থানান্তরিত হয় । এখানে উল্লেখ্য কুতুব শাহী আমলেই দূর্গটি ৫ কিমি বিস্তৃত হয় , পরবর্তী ৬২ বছরে আরও ৭ কিমি বিস্তৃত হয়। সেকালে দূর্গের চারপাশে পরিখা ছিল । ৩৬০ ধাপ সিঁড়ি উঠে পাহাড় চূড়ায় খিলান যুক্ত ত্রিতল তানা শাহী কি গদি বা দরবার হল । সিঁড়ি পথের ডানদিকে ঝরনায় সুশোভিত পাতকুয়া ছিল । ১৬৮৭ সালে ঔরঙ্গজেব কর্তৃক আটমাসের অবরোধে দূর্গটি ভেঙ্গে যায় । একজন গাইড নেওয়া হলো যাতে দেখার সাথে সাথে ইতিহাসকে জানাও যায় । ১০কিমি বিস্তৃত অর্ধচন্দ্রাকৃতি গোলকোন্ডা দূর্গটি অভ্যন্তরে ৪ টি স্বতন্ত্র দূর্গ, ৮টি প্রবেশপথ, ৪ টি টানাসেতু, বেশকিছু রাজকীয় ভবন, হল, মন্দির, মসজিদ, অস্ত্রাগার, আস্তাবল নিয়ে গঠিত । সবচেয়ে নিচে বাইরের দিকে আছে ফতেয় দরওয়াজা, এখান দিয়েই ঔরঙ্গজেবের বিজয়ী সেনা দূর্গে প্রবেশ করেছিল । এই দরজাই বড় বড় লোহার খিলান দিয়ে তৈরী করা যাতে হাতি ও সৈন্য আক্রমণ প্রতিহত করা যায় । দরজা পেরোতেই একটা গম্বুজ, এর নির্দিষ্ট স্থানে হাততালি দিলে তা ১কিমি দূরে অবস্থিত বালা হিশার প্যাভেলিয়ানে শোনা যেত । গম্বুজ পেরিয়ে বাঁদিক দিয়ে সোজা গেলেই সুন্দর বাগান ,যা ৪০০ বছরের অতীত গৌরবের কথা স্মরন করিয়ে দেবে । কথিত আছে দরবার থেকে পাহাড়ের পাদদেশ অবধি একটা সুড়ঙ্গ পথ ছিল । দূর্গের ওপর দিকে কুতুব শাহী সুলতানদের ইসলামিক রীতিতে গঠিত সমাধী, কালা মন্দির, দরবার ছিল ।আর দূর্গের ভিতর দিকে মনিমুক্ত খচিত নানান প্রাসাদ, হারেম মহল, মন্দির,তামার ফোয়ারায় গোলাপ জলের তার্কিশ বাথ, ত্রিতল তোপখানা, অন্ধকার কারাগার, হাবসি কামান, আশলা খানা, তারামাটি মসজিদ, রামদাস বন্দিখানা, উটের আস্তাবল, অম্বরখানা, দরবার হল, নাগিনা বাগ, রামসসা কোঠা ইত্যাদি । তবে স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন সবই ধংসের মুখে । সেভাবে রক্ষনাবেক্ষণও চোখে পড়লো না । তবে যত উপরে উঠেছি সিঁড়ি ক্রমশ চড়াই এবং কিছু কিছু জায়গায় সিঁড়ির কোনো অস্তিত্ব নেই । তবে যে কথা বলতেই হয় গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে রক্ষা পাবার জন্য জটিল ভাবে দূর্গের নকশা বানানো এবং সমস্ত দূর্গ জুড়ে সেই সময়েই জল সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল । মাটির নল ও পার্সিয়ান চাকার সাহায্যে ছাদের ওপর জল তুলে ঠান্ডা রাখা হতো প্রাসাদ । গোলকুন্ডার হীরের জগৎ জোড়া নাম ছিল অতীতে । কৃষ্ণা অববাহিকায় পাওয়া যেত হীরে , আরব, পারস্য, তুরস্ক থেকে ব্যবসায়ীরা আসত । এমনকি ব্রিটিশ মুকুটে কোহিনুর হীরেটিও এই গোলকোন্ডার নাম উজ্জ্বল করে । এখানে রাতে লেজার শো'র ব্যবস্থা আছে । অমিতাভ বচ্চনের কন্ঠে ১ ঘন্টার গোলকোন্ডার ইতিহাস শোনা যায় ধারাভাষ্যে ।
এরপর গন্তব্য কুতুব শাহী সমাধী ক্ষেত্র । কুতুব শাহী সমাধী স্থল গোলকোন্ডা ফোর্ট থেকে অনতিদূরে ইব্রাহিম বাগে অবস্থিত । শাহী সুলতানদের সমাধী শায়িত থাকলেও শাহী রাজত্বের পরবর্তী কালে যথেষ্ঠ উপেক্ষিত হয়েছিল, তবে ৩য় শতকে সালার জং সাহেবের তৎপরতায় আবার তা পূননির্মিত হয় । এখানে মূলত দুধরনের সমাধী চোখে পড়ে । ছোট সমাধী গুলির গ্যালারীতে একক মন্দিরে থাকে এবং বড়গুলি দুটি তলা ও মন্দির বা চূড়া । কথিত আছে ঔরঙ্গজেব এখানে নামাজ পড়তেন । সম্প্রতি খনন কার্যের ফলে কুতুব শাহী সুলতানদের গ্রীষ্মাবাসও আবিষ্কৃত হয়েছে ইব্রাহিম বাগের মাটির নিচে । তবে নিরিবিলি শান্ত এই পরিবেশে বেশ কিছুটা সময় একাকি কাটানো যায় ।
এরপর অল্প সময়ের জন্য ঘুরে আসতেই পারেন শিল্পরমম থেকে । হাইটেক সিটি থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত ৩০ একর জমির ওপর শিল্প ও সংস্কৃতির অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছে এক ছাদের তলায় । ঝর্না ও ঘাসের জাজিমে (গদি বিশেষ) পাথর খোদাই করে তৈরি হয়েছে নানা শিল্প সম্ভার । সারা ভারত থেকে আগত শিল্পীদের সৃষ্ট শিল্প দেখা ও কেনার ব্যবস্থা আছে । বিভিন্ন ধরনের মূর্তি (মাটি ও পাথরের) , হায়দ্রাবাদের ঐতিহ্য ( শাড়ি , গহনা) সবই সহজলভ্য এখানে ।
হায়দ্রাবাদের অপর আকর্ষণীয় স্থান হায়দ্রাবাদ - বিজয়ওয়ারা হাইওয়ের হায়াৎনগরের রামোজি ফিল্ম সিটি । হাইটেক সিটি থেকে পৌঁছাতে সময় লাগল ১.৩০ ঘন্টা (প্রায় ৬৭ কিমি ) । হায়দ্রাবাদ শহর থেকে ও অন্ধ্রের নানান শহর থেকে বাস আসছে একেবারে ফিল্ম সিটির প্রবেশ দ্বারে । ভিতরে ঢোকার পর অনেক ক্ষন অপেক্ষা করতে হয়েছিলো , একে তো ডিসেম্বরের প্রচন্ড ভিড় ,তায় আমাদের দুটো বাসে অফিস কলিগ ও তাদের ফ্যামিলি মিলিয়ে ১২০ জন । বিভিন্ন মূল্যের টিকিট পাওয়া যায় , তাতে বিভিন্ন প্যাকেজ । আমাদের ২৫০০/ পার পারশন লেগেছিল ।
রামোজি ফিল্ম সিটি সম্পর্কে যে কথা না বললেই নয় , ১৯৯১ সালে রামজি গ্রুপের প্রধান রামজি রাও কর্তৃক স্থাপিত ফিল্ম সিটি 2500 একরেরও বেশি বিস্তৃত এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম স্টুডিও কমপ্লেক্স হিসাবে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তুলেছে । এখানে একত্রে 20 টি চলচ্চিত্র ইউনিট কাজ করতে পারে । যাই হোক সেখানেই আধ ঘন্টার মত অপেক্ষা করার পর সকলেই হাতে একটা করে ব্যাচ পেলাম , সেগুলো জামার ওপর বুকে সেঁটে দিতে হলো ।
তারপর আবার নিজেদের বাসে উঠে আরও কিছু দূর গিয়ে ছেড়ে দিতে হলো বাস । এরপর বাকি যাত্রা সম্পন্ন হলো রামোজির নিজস্ব ভিনটেজ বাসে । দীর্ঘ লাইন অতিক্রম করে উঠে পড়লাম লাল রঙের ভিনটেজ বাসে । প্রতি বাসে একজন করে গাইড রয়েছে । ডাইনে বায়ে নানা রঙের অনেক বিল্ডিং চোখে পড়ল , সব কটারই ইতিবৃত্ত শোনালেন গাইড, কোনোটায় সূর্যবংশম এর শুটিং হয়েছে তো কোনোটায় রকস্টার, তো কোনোটায় আশিকি ২, জেলখানার শুটিং, এয়ারপোর্ট ও প্লেনের ডামি সেট , চেন্নাই এক্সপ্রেস খ্যাত বিজয়ওয়ারা স্টেশন যার একদিকে গ্রামের দৃশ্য অপর দিকে শহরের সেট , ইউরেকা জং, বিল্ডিং স্ট্রাকচার, গ্রামের ডামি সেট, মহাভারতের সেট, কৃপালু গুহা , হাওয়া মহল ( এখানে টি ব্রেকের ও ব্যবস্থা আছে), জাপানি গার্ডেন, হলিউড সাইনেজ, লন্ডন স্ট্রিট, ল্যাবরেটরিজ, হাসপাতাল, ল্যান্ডস্কেপ, বাটারফ্লাই পার্ক, উইং বার্ড সেঞ্চুচুয়ারি ( এখানে মডেল পাখি ও শো পিসের দোকান ও আছে ), ভমন বনসাই বাগান , সান ফাউন্টেন ডামি সেট, মুভি ম্যাজিক । এছাড়াও অনেক রকম শো হয় তার জন্য আলাদা প্রবেশ মূল্য । যেমন লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন ( হলিউড ব্যাকলাইট স্পেকটাকুলার), অ্যাকশন থিয়েটার ( লাইভ মুভি ক্রিয়েশন) , ডান্স শো ( স্পিরিট অফ রামোজি) , ফোর্ট ফ্রন্টটেয়ার ( ওয়াইল্ড ওয়েস্ট স্টান শো) । তবে একটাই অসুবিধা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা যেতে হলে হাঁটার কোনো অপশন নেই, ওই রামোজির বাসে আপনাকে উঠতেই হবে, সব সময় যে ভিনটেজ বাস আসছে তা নয়, ওটা প্রথমবার ছিল, তার পরের গুলো এমনি বাস, এমনকি স্কুল বাস ও ছিল । পিক সিসন হওয়ায় ভিড়ও প্রচন্ড , তাই বেশ গুতোগুতি করেই বাসে উঠতে হয়েছে এমনকি এক জায়গায় তো রিতিমত মারামারি করে । এই এক জায়গায় বড্ড অবহেলা অনুভব করেছি । এত এত টাকা দিয়ে টিকিট কাটার পর বাস ধরার জন্য এই পদ্ধতি আশাতীত । রামোজির তরফ থেকে যদি একটু সুবন্দোবস্ত করতো তাতে দর্শকদেরও সুবিধা হয় ।
একদিনে রামোজির সব কিছু দেখা সম্ভব নয় , ১ রাত থেকে দেখারও ব্যবস্থা আছে । সেরকম প্যাকেজ ও বাছাই করতে পারেন । সিতারা , সাহারা , বসুন্ধরা, তারা নামের তারকা হোটেল রয়েছে এছাড়াও প্রচুর রেস্টুরেন্ট আছে । সারাদিন ধরে হেঁটে হেঁটে পা গুলো একটু বিশ্রাম চায় । এরপর হোটেলে ফেরার পালা ।
পরদিন আমাদের গন্তব্য ছিল হুসেন সাগর লেক । হায়দ্রাবাদ ও সেকেন্দ্রাবাদের সংযোগকারী বাঁধ গড়তে হুসেন সাগরের সংস্কার । কথিত আছে , ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভের ফলে হুসেন শাহ ওয়ালির প্রতি কৃতজ্ঞতা বশত ১৫৬২ সালে ইব্রাহিম কুলী কুতুব শাহ লেক খনন করেন । সকাল ও সান্ধ্য ভ্রমণের জন্য এটি আদর্শ স্থান । বিভিন্ন রকমের বোটিং করে লেক ভ্রমনের ব্যবস্থা আছে । লেকের মাঝে স্ট্যাচু টি দারুন । তবে এই সাগরের জল ভয়ঙ্কর নোংরা । নানা ভাবে দূষিত এবং আমরা নিজেরা দেখেছি ক্রেন দিয়ে নোংরা , প্লাস্টিক তোলা হচ্ছে । পাশেই আছে লুম্বিনী পার্ক , মূলত এটি প্রাত ভ্রমণ ও সান্ধ্য ভ্রমণের জন্য আদর্শ । তবে সন্ধ্যায় লেজার শো হয়।
এবার আমাদের বাস এগিয়ে চলল মুসি নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত সালার জং মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে । যেতে যেতেই চোখে পড়ল নর্দমায় ও আস্তাকুঁড়ে পরিনত হওয়া মুসি নদী । নিজামের প্রধানমন্ত্রী মীর ইউসুফ আলী খান ( ৩য় সালার জং) ১৯১৪ সালে চাকরি ছেড়ে নিজের সংগ্রহ বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেন । তার মৃত্যুর পর ১৯৫১ সালে জহরলাল নেহরু জালার জং প্যালেসে মিউজিয়াম গড়ে তোলে জাতীয় স্বার্থে । তবে পরবর্তী কালে বর্তমানের নতুন ভবনে মিউজিয়াম স্থানান্তরিত হয় , একক সংগ্রহে বিশ্বের অন্যতম মিউজিয়াম এটি । মূলত মেইন, ওয়েস্টার্ন, ইস্টার্ন এই ৩ টি জোনে ৩৫ টি রুমে ৩৫০০০ সম্ভার সুসজ্জিত আছে । তবে কথিত আছে অনেক জিনিসই জায়গার অভাবে বাক্সবন্দী হয়ে আছে আজও । সামান্য কিছু টাকায় টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম ভিতরে , তবে সঙ্গে কোনো জিনিস নিয়ে যাওয়া যায়না , (মানিব্যাগ ছাড়া) । এখানে বলে রাখি বিনা পয়সায় গাইড ও মেলে আধা ঘন্টার জন্য , কিন্তু ওই পিক সিজনে তাদের দেখা মেলা দুষ্কর । অগত্যা নিজেরাই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, সবেরই বর্ননা রয়েছে , একটু সময় লাগবে এই আর কি ।
চীন , জাপান, বর্মার পৃথক হল আছে , তাছাড়াও জুয়েল হল, পেয়েন্টিং হল, স্কাল্পচার হল, ম্যানুস্ক্রিপ্ট হল আছে । নূরজাহানের ড্যাগার, টিপুর হাতির দাঁতের চেয়ার, ঔরঙ্গজেবের তরোয়াল, জাহাঙ্গীরের মদ্যপানের কাপ দেখার মত , যেন মনে ইতিহাস কথা বলছে । এছাড়াও আছে ব্রোঞ্জ ও টেক্সটাইলের রুম, পাথরের মূর্তির রুম, দক্ষিণ ভারতীয় শিল্প সম্ভার, বয়ন শিল্প, বিভিন্ন ধরনের ঘড়ি, বিদেশী পুতুল(R7), হাতির দাঁতের রকমারি শিল্প, বিভিন্ন সুলতানদের তরোবারি , বন্দুক ও নানান অস্ত্রসস্ত্র , ধাতব সম্ভার, ছবির সংগ্রহ শালা , পুতুল ও খেলনার সম্ভার( R16), মর্ডান আর্টের সম্ভার ( অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি স্থান পেয়েছে), ধর্মীয় শিল্পকলার সম্ভার, কাশ্মীরের কার্পেট ও আসবাবপত্রের সম্ভার, ফরাসী ও ইউরোপীয় শিল্প কলা, পোর্সেলিনের বাসনপত্র নিয়ে এক বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ শালা । এছাড়াও রেবেকার অবগুন্ঠিতা সুন্দরী নারী মূর্তি ( যেটা ৭লক্ষ টাকা দিয়ে রোম থেকে আনা হয় ১৮৭৬সালে), একই কাঠের গুঁড়িতে একদিকে নারী ও অপর দিকে পুরুষ মূর্তিটিও নজর কাড়ে । যেকথা বলতেই হবে এই বিশাল বড় মিউজিয়াম দেখতে একটা গোটা দিন লাগবেই ।কাজেই সেই ভাবে সময় নিয়ে যাবেন ।
এখান থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল , এবার আমরা অফিসের বাস ছেড়ে দিয়ে নিজেরা স্বামী স্ত্রী ও ছানা বেরিয়ে পড়লাম একটা অটো নিয়ে চারমিনারের উদ্দেশ্যে । মিনিট ৫ এর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পুরোনো হায়দ্রাবাদের প্রাণকেন্দ্র চারমিনারে । শহর থেকে প্লেগ মহামারী দূর করে স্মারক রূপে মহম্মদ কুলী কুতুব শাহ ১৫৯৩ সালে সম্পন্ন করেন চুন ও পাথরের তাজিয়া ঢঙে কারুকার্যময় হলুদ রঙের এই চারমিনারটি । কথিত আছে এই স্থানেই নাকি নবাব ভাগমতীকে দর্শন করেন । চারটি সরু মিনার চারপাশে , চারদিকে চারটি গেট এবং ১৪৯ ধাপের স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে মিনারের ওপরে ওঠা যায় । দোতলায় মন্দির, তিনতলায় মসজিদ, এখানে নবাব পরিবারের শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল একসময় । রাতে আলোক মালায় সেজে ওঠে যদিও তা দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের । এই চারমিনার চত্বরটাকে কলকাতার ধর্মতলার সাথে তুলনা করলে খুব একটা ভুল হবে না । চারিদিকে জিনিস পত্রের সম্ভার নিয়ে বেচাকেনা চলছে , এটা হায়দ্রাবাদের পুরোনো লাড বাজার, এখানে খরিদ্দারও লোকাল । কি নেই এখানে, বালা চুড়ি, কঙ্কন, বিদরি শিল্পের নানান জিনিস, সোনা রুপার ঝালরের কারুকার্যময় পোশাক, ব্রোকেড শাড়ি, শেরওয়ানি দুপাট্টা , রকমারি লুঙ্গি, কলমকারি বেডকভার, হুকা রেকাবি বাক্স ,অ্যান্টিক জিনিস সব আছে , তবে জিনিস বুঝে তার দাম ও আছে ।
মনে রাখবেন
১) সমগ্র হায়দ্রাবাদ শহরেই ওলা ক্যাব ও ওলা অটো ছুটছে , লোকাল ট্রান্সপোর্ট ধরেই ঘুরে নেওয়া যেতে পারে।
২) হায়দ্রাবাদ শহরে গিয়ে অবশ্যই প্যারাডাইস রেস্টুরেন্টে মোগলাই খাবার খেয়ে দেখবেন, শহরের ২/৩ জায়গায় ওদের শাখা আছে । এছাড়াও আরও অনেক দোকান আছে ।
৩) হায়দ্রাবাদি পার্ল কিনতে চাইলে দোকানের রেফারেন্স নিয়ে গিয়ে কেনা ভালো । না হলে ঠকে যাবার সম্ভাবনা প্রবল , বিশেষ করে চারমিনার এলাকায় ।
৪) এছাড়াও অনেক দেখার মতো জায়গা হায়দ্রাবাদে রয়েছে , যেমন ওসমান সাগর , ডিয়ার পার্ক , ফলকনামা প্রাসাদ , বোটানিক্যাল গার্ডেন বা পাবলিক গার্ডেন, মক্কা মসজিদ ও জামি মসজিদ ইত্যাদি ।
২) হায়দ্রাবাদ শহরে গিয়ে অবশ্যই প্যারাডাইস রেস্টুরেন্টে মোগলাই খাবার খেয়ে দেখবেন, শহরের ২/৩ জায়গায় ওদের শাখা আছে । এছাড়াও আরও অনেক দোকান আছে ।
৩) হায়দ্রাবাদি পার্ল কিনতে চাইলে দোকানের রেফারেন্স নিয়ে গিয়ে কেনা ভালো । না হলে ঠকে যাবার সম্ভাবনা প্রবল , বিশেষ করে চারমিনার এলাকায় ।
৪) এছাড়াও অনেক দেখার মতো জায়গা হায়দ্রাবাদে রয়েছে , যেমন ওসমান সাগর , ডিয়ার পার্ক , ফলকনামা প্রাসাদ , বোটানিক্যাল গার্ডেন বা পাবলিক গার্ডেন, মক্কা মসজিদ ও জামি মসজিদ ইত্যাদি ।
No comments