পাথরা স্থানটির গুরুত্ব বুঝতে হলে সময়কে তোয়াক্কা না করে পিছিয়ে যেতে হবে অষ্টম দশকে যখন তাম্রলিপ্ত বন্দরের পশ্চাদভূমি হিসেবে এই স্থানের নাম ছিল, হিন্দু বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মীয়দের সাংস্কৃতিক পীঠস্থল ছিল এই অঞ্চল। এখানে ষাটের দশকে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় বিশালাকার বিষ্ণুমূর্তি উদ্ধার হয়েছিল।
আজ যে মন্দিররাজির জন্য পাথরা যাওয়া যায় সেগুলি যদিও অনেক পরের সৃষ্টি, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে। ৩৯ টি মন্দির, যার অনেকগুলোই আজ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবলুপ্তির পথে। সেই আমলে নবাব আলীবর্দী খাঁ এই জাগিরে নিযুক্ত করলেন বিদ্যানন্দ ঘোষালকে, রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে। হয়তো নবাব অধীনতার মনকুণ্ঠা বা কোনো ধর্মীয় চিন্তনের উন্মেষ থেকে, তিনি শুরু করলেন মন্দির নির্মাণ। নবাব স্বভাবতই খুশি তো হলেনই না, উপরন্তু দণ্ডাদেশ দিলেন বিদ্যানন্দকে উন্মাদ হাতির পদপিষ্ট করার। কিন্তু কোনো এক দৈবাৎ কারণে হাতিটি পা তুলেও পিছু হটে এবং জীবনলাভ করেন বিদ্যানন্দ। এই পা উৎরানোকে স্মরণীয় রাখতেই জায়গাটির নাম হয় পাউৎরা যা থেকে পাথরা নামটি এসেছে।
ঘোষালেরা রয়ে গেলেন এই গ্রামেই, এবং দ্বিগুণ উৎসাহে নির্মাণ করলেন আরো মন্দির, কাছাড়িবাড়ী, রাসমঞ্চ। তাদেরই বংশধর বন্দ্যোপাধ্যায় উপাধী নিয়ে নির্মাণ করলেন দূর্গাদালান, ও আরো কিছু মন্দির। পাথরা হয়ে উঠলো এক রূপকথাময় মন্দির নগরী।
ঊনবিংশ শতকে উভয় পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা নিম্নগামী হতে থাকে এবং তারা এই স্থান ত্যাগ করেন। মন্দিরগুলির মালিকানা চলে যায় অন্য এক শ্রেণীর লোকেদের হাতে, যাদের অবহেলায় ও অযত্নে আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে পঞ্চাশ ভাগ মন্দির। সংরক্ষণের চিন্তা আসে ষাটের দশকের শেষের দিকে।একসাথে এতগুলো শিব মন্দির কাশী ছাড়া আর কোথাও পাওয়া দুষ্কর।
দুই শতকের বেশী বয়সের ৩৯ টি মন্দির, একটি রাসমঞ্চ, বেশ কিছু ঠাকুরদালান আর দুর্গামণ্ডপ...এই নিয়ে পাথরা। ঠিকানা পঃ মেদিনীপুরে, সদর থেকে দশ কিমি পূর্বে, কাঁসাই নদী বরাবর। টেরাকোটা মন্দির গুলি তৎকালীন বঙ্গীয় স্থাপত্য ও ইসলামিক শৈলীর যৌথ নিদর্শন।
তবে বর্তমানে পাথরার কথা বললে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে মাননীয় ইয়াসিন পাঠান এর কথা। পাথরার পাশের গ্রাম হাতিহলকারের সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান , যিনি ১৯৭১ সাল থেকে নিঃস্বার্থে লড়ে যাচ্ছেন মন্দিরগুলি বাঁচানোর লড়াই। ১৯৯০ সালে তৈরী করেছেন "পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ সমিতি " । তার নিরলস প্রচেষ্টায় ২০০৩ সালে ASI মন্দিরগুলোকে তাদের তালিকাভুক্ত করে। আজ ইনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ, আরো অবনত তার কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ার বেদনায়। তার বই "মন্দিরময় পাথরার ইতিবৃত্ত" কাছাকাছি এলাকার যেকোনো দোকানে প্রাপ্ত।
No comments